রোজার আগে প্রবাসী আয়ে বড় পতন

শেখ আবু তালেব: বাংলাদেশী প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মুসলিম দেশগুলো। তবে করোনাভাইরাসের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ছে সেখানকার অর্থনীতি। একই চিত্র ইউরোপের দেশগুলোরও। লক-ডাউনের কারণে বাসায় বসে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের।

### বিদেশি মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত হয়েছিল খাতটি। লক ডাউনকালীন বাসায় বসে থাকায় রোজগারহীন হয়ে পড়ছেন প্রবাসীরা।

নিজেই চলছে কোনো মতে। ফলে দেশে কোনো অর্থ পাঠাতে পারছেন না বেশিরভাগ প্রবাসী। এতে অর্ধেকে নেমে গেছে প্রবাসী আয়। চলতি মাস এপ্রিলের প্রথম ২২ দিনে প্রবাসীরা মোট ৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ব্যাংকিং চ্যানেলে, যা গত মার্চ মাসের তুলনায় অর্ধেক।

রমজান, কুরবানির ঈদ ও হজের আগেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে দেশে। এবার রমজান শুরু হলেও রেমিট্যান্সের সেই পালে হাওয়া নেই। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। প্রবাসী কর্মী যাওয়া অধ্যুষিত জেলাগুলোর মানুষের সংসার চলে প্রবাসী আয় দিয়ে। নতুন সংকটে তাদের জীবন-ধারন অনেকটাই বদলে যাবে।

এর প্রভাব পড়বে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতেও। বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রা আয়ের খাতগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয় অন্যতম। এ দুটি খাত দিয়েই মূলত সমৃদ্ধ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এরমধ্যে তৈরি পোশাক খাতের আয়ের একটি অংশ চলে যায় আবার কাঁচামাল আমদানিতে। কিন্তু প্রবাসী আয়ের পুরোটাই দেশেই থাকে।

এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নির্ভযোগ্য খাতে পরিণত হয়েছিল প্রাবসী আয়। এতে ভর করেই সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তবে অর্থনীতির অন্যান্য সূচক গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নেতিবাচক হয়ে আসছে।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল প্রবাসী আয়। এবার সেই সূচকেও বড় পতন হলো। জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) আক্রমণে থমকে গিয়েছে পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক তৎপরতা। বাদ যায়নি সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।

এছাড়া একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলো ও বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। সৌদি আরবের রিয়াদে থাকছেন এক প্রবাসী বাংলাদেশি মোহাম্মাদ মুসা। তিনি প্লাস্টিক পণ্য তৈরি কোম্পানির এসি সেকশনে কাজ করেন। রেমিট্যান্স কমে আসার কারণ হিসেবে তিনি জানান, এখন কেউ বাসার বাইরে বের হতে পারে না।

কিছু কোম্পানি সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে অল্প পরিসরে কাজ করছে। কিন্তু কর্মীদের আনা-নেওয়া হচ্ছে বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। সকাল আটটায় অফিস খুললেও দুইটার মধ্যে সব বন্ধ। এখানকার প্রশাসন খুবই কড়া। দুটোর পরে কাউকেই বাইরে থাকতে দেয় না।

মুসা জানান, কোম্পানির পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতির একটি কাগজ সবাইকে দেয়া হয়েছে। যদিও এটির প্রয়োজন হয় না। কারণ আমরা সবাই কোম্পানির গাড়িতেই চলাচল করি। কিন্তু তারপরও গাড়ির সঙ্গে থাকলেও কর্মীদের দেয়া হয়েছে। বাসা ও কোম্পানিতে প্রবেশের সময় স্বাস্থ্য বিধি পুরোপুরি মেনে চলতে হয়। অল্প সংখ্যক লোক শুধু দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য কাজে যাচ্ছেন।

বাকিরা বাসায় বসে রয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কেউই দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। এরকম আরো কয়েকজন প্রবাসী অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমে এ প্রতিবেদককে জানান, প্রবাসীদের হাতে যে অর্থ আছে-তা দেশে পাঠানোর মতো নয়। এই অর্থ দিয়েই তাদের কোনো রকমে চলতে হচ্ছে।

সবাইকে কোম্পানি খাবারও সরবরাহ করে না। ফলে দেশে টাকা পাঠাবে কিভাবে? এদিকে রেমিট্যান্স কমে আসায় বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চাপ সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলার ছাড়তে শুরু করেছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা কিনে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের আলোচিত মাসের চেয়ে তা ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

চলতি এপ্রিলের প্রথম ২২ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। যদিও মার্চ মাসের ২২ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১১০ কোটি ডলার।

তথ্য বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে এক কোটির মতো প্রবাসী রয়েছেন। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে তারা এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ (১৬.৪২ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন, যা পূর্ববর্তী অর্থ বছরের (২০১৭-১৮) চেয়ে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৪৯৮ কোটি ১৭ লাখ (১৪.৯৮ বিলিয়ন) ডলার, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি ছিল।

এদিকে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। বর্তমানে দেশে মাস ভিত্তিক গড় আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি ডলার।

এ হিসাবে বাংলাদেশ এখনও আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয়ও কমেছে। আবার করোনাভাইরাসের কারণেও সামগ্রিক আমদানি কমে গিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি চার দশমিক ৪৪ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৪৫৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।##