রোজা শ্রেণিবৈষম্য ও অসাম্য দূর করে

  মাওলানা নাসির উদ্দিন : বিত্তবান কর্তৃক দরিদ্রদের নতুন জামা-কাপড় প্রদানে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। যে সৌন্দর্য পবিত্র রমজানের সহমর্মিতার মোড়কে বিমূর্ত হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে, শত-সহস্র কাল ধরে। রমজান মাসের সহমর্মিতার এই শুভ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বছরব্যাপী অনুশীলন করলে মানবসমাজে আর দেখা যাবে না কোনো রকম অসাম্য ও শ্রেণিবৈষম্য। দূর হয়ে যাবে ক্ষুধা, দূর হবে দারিদ্র্য ও অশান্তি আর হানাহানি। কারণ ইসলামের মহান শিক্ষা যদি কোনো জাতি, সমাজ বা কোনো ব্যক্তির মাঝে থাকে, তাহলে প্রতিটি সমাজে শান্তির হাওয়া বইতে থাকবে। আর যদি তা অমান্য করে চলে, তাহলে সমাজের প্রতিটি স্তরে অশান্তি থেকেই যাবে। তাই আসুন, পবিত্র এই রমজান মাস থেকে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনের জীবন পরিচালনা করি। তাহলেই সার্থক হবে সমাজ, সার্থক হবে দেশ ও জাতি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে কবুল করুন এবং আমাদের মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিন। (আমিন)

রোজার আমল হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে: মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র রমজানের ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত ১৮৩)

উল্লিখিত আয়াত দ্বারা এ কথাই বোঝা যায় যে, পূর্বে সব শরিয়তেই রোজা ফরজ ছিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

হজরত আদম (আ.)-এর যুগে রোজা: আগের শরিয়তসমূহে রোজা কোন ধরনের বা কত দিনের ছিল, কোন মাস বা কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত ছিল কি না, এ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অত্যন্ত মুশকিল। আল্লামা আলুসি (রহ.)-এর মতে, হজরত আদম (আ.)-এর প্রতিও রোজার হুকুম ছিল; কিন্তু সে রোজার বিস্তৃত বর্ণনা আমাদের জানা নেই। এ সম্পর্কে আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহ.) উল্লিখিত আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘রোজার হুকুম যথারীতি হজরত আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিদ্যমান। এ সম্পর্কে অন্যান্য তাফসির বিশারদও এ ধরনের মত পোষণ করেন।’

হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে রোজা: হজরত নূহ (আ.)-কে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম রাসুল হিসেবে ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘আপনি বিশ্ববাসীর মাঝে শরিয়ত বর্ণনাকারী প্রথম রাসুল।’ আল্লামা ইবনে কাছির (রহ.) তার স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসিরে লিখেছেন, হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ থেকে প্রত্যেক মাসেই তিনটি রোজা পালন করার হুকুম ছিল এবং এ হুকুম বিশ্বনবী (সা.)-এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। অতঃপর যখন রমজানের রোজা পালনের হুকুম হলো, তখন থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের হুকুম রহিত হয়ে গেল। এ বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, হজরত নূহ (আ.)-এর যুগেও রোজার বিধান চালু ছিল।

হজরত মুসা (আ.)-এর যুগে রোজা: আল্লাহতায়ালা যখন হজরত মুসা (আ.)-কে তুর পর্বতে ডেকে তাওরাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.)-কে সেখানে ৩০ রাত অবস্থানের নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং স্মরণ করো ওই সময়কে, যখন আমি মুসার জন্য ৩০ রাত নির্ধারণ করেছিলাম এবং আরও ১০ দ্বারা এটা পূর্ণ করেছিলাম। এভাবে তাঁর প্রতিপালকের নির্ধারিত ৪০ রাত পূর্ণ হয়। হজরত ইবনে আব্বাসের মতে, হজরত মুসা (আ.) জিলকদ মাসের ৩০ দিন ও জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালত করে আল্লাহর দরবারে হাজির হন এবং তাওরাত লাভ করেন। এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, হজরত মুসা (আ.)-এর যুগেও রোজার হুকুম ছিল।’

হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগে রোজা : হজরত দাউদ (আ.) অর্ধবছর রোজা রাখতেন। অর্থাৎ তিনি একদিন পরপর রোজা রাখতেন। বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় পাওয়া যায়Ñহজরত ইবনে আমর (রা.)-কে নবী করিম (সা.) রোজা পালনের আদেশ এভাবে করেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে যে রোজা উত্তমÑসেই রোজা রাখ। আর সেই রোজা হলো যা হজরত দাউদ (আ.) রেখেছেন।’ তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর একদিন ইফতার (রোজা ভাংতেন) করতেন। এ হাদিস থেকে হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগের রোজার সন্ধান পাওয়া যায়।

বাইবেলে রোজা: বাইবেলে ‘দার’ বাদশাহের যুগে বাইতুল ইলের বাসিন্দা ও বনি ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার হুকুমের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এমনিভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সব শরিয়তেই রোজার সন্ধান পাওয়া যায়।