Print Date & Time : 4 August 2025 Monday 12:10 am

রোড ক্র্যাশ ‘দুর্ঘটনা’ নয় এসব দুঃখজনক ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য

আমিনুল ইসলাম সুজন কৃষ্টি সাপোরিতো: এমন একটি মুহূর্তের কথা চিন্তা করুন যে, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আপনি আকস্মিক তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়েছেন। অনাকাক্সিক্ষত বা অপ্রত্যাশিত এ ঘটনাকে ‘দুর্ঘটনা’ বা ‘দুর্ভাগ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আকস্মিকভাবে যে কোনো ব্যক্তি এমন একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে আমরা যখন সড়কে মৃত্যুর কারণগুলোকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করি, আমরা আসলে ভুল শব্দ ব্যবহার করি। কারণ সড়কের মৃত্যুর অধিকাংশই দুর্ঘটনা নয়, রোড ক্র্যাশ এবং এর প্রতিরোধ আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে রোড ক্র্যাশের কারণে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টির আবহাওয়ার মতো এসব মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ নয়। সড়কে মৃত্যুর মতো সমস্যাটি বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) যৌথ উদ্যোগে জাতীয়ভাবে পরিচালিত পরিবারভিত্তিক জরিপ ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে, ২০১৬’ অনুযায়ী, দেশে আঘাতজনিত স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য দ্বিতীয় প্রধান কারণ রোড ক্র্যাশ। এ হিসাবে আরও দেখা যায়, গড়ে প্রতিদিন ২২০ জন স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয় এবং পরিবার ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাপী রোড ক্র্যাশ পাঁচ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, রোড ক্র্যাশ বা সড়ক পরিবহনজনিত (রোড ট্রাফিক) কারণে ১৩ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। এছাড়া ৫০ লক্ষাধিক মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়। গবেষকেরা মনে করেন, এশিয়া ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন মহাদেশের অনেক দেশের দরিদ্র, উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত ও মধ্য আয়ের সব দেশের প্রকৃত তথ্য পাওয়া গেলে মৃত্যুসংখ্যা ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতো।

বিভিন্ন কারণে সড়কে মানুষ মারা যায়, যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন: সড়ক ও যানবাহন প্রস্তুত/নির্মাণের সময় নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া, পথচারী ও অযান্ত্রিক যানের জন্য সড়ক নিরাপদ করা ও এজন্য গতি নিয়ন্ত্রণ করা, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক ও সড়ক পরিবহন-সংক্রান্ত আইনকানুন তৈরি ও বাস্তবায়ন এবং শিশু-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সী, লিঙ্গ ও শ্রেণির জন্য যাতায়াত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে অধিকাংশ রোড ক্র্যাশ পরিহার করা সম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোড ক্র্যাশ এবং এ কারণে অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির মতে, এসব কারণ সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং খুব সহজে ও সাশ্রয়ী উপায়ে সমাধানের মাধ্যমে রোড ক্র্যাশজনিত অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব। রোড ক্র্যাশজনিত মৃত্যু কমাতে যেসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তার মধ্যে রয়েছেÑ

#             সড়কে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে আইন প্রণয়ন, যেখানে বিভিন্ন সড়ক ও যানবাহনের ধরন অনুযায়ী গতি নিয়ন্ত্রণ করা;

#             মোটরসাইকেলের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার-বিষয়ক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা;

#             যানবাহনে চালক ও যাত্রীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে (যেমন সিটবেল্ট, শিশুদের পৃথক আসন প্রভৃতি) প্রাধান্য দেয়া;

#             সড়ক ব্যবহার ও আইনি বিধিনিষেধ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে ধারাবাহিক ও কৌশলগত প্রচারণা অন্যতম।

যানবাহনের গতি রোড ক্র্যাশের অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত গতি বা অনিয়ন্ত্রিত গতি রোড ক্র্যাশের ঝুঁকি ও এর পরিণতির ভয়াবহাÑদুটোই বৃদ্ধি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,  পাঁচ শতাংশ গতি কমালে প্রাণঘাতী ক্র্যাশের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ কমে আসবে। সড়ক ব্যবহারের ধরন, যানবাহন ও সড়কের ধরন অনুযায়ী গতি নিয়ন্ত্রণ করা সবার নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে উৎসাহিত করতে ২০২১ সালে একটি বৈশ্বিক প্রচারণা কর্মসূচি পরিচালনা করে। ‘জীবনের জন্য সড়ক’ শীর্ষক এ বৈশ্বিক কর্মসূচির মাধ্যমে সংস্থাটি রাষ্ট্রগুলোকে নিজ নিজ দেশের শহরগুলোয় যানবাহনের গতি ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখার আহবান জানায়। বিশেষ করে শহরের অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো, যেখানে পথচারী, বাইসাইকেল ও অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহারকারীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী রয়েছেন।

বর্তমানে বাংলাদেশের সড়কগুলোয় সড়ক ও সড়ক ব্যবহারের ধরন এবং যানবাহনের ধরন অনুযায়ী গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন বা নীতি নেই। আশার কথা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) একটি গতিসীমা নির্ধারণমূলক একটি জাতীয় নির্দেশিকার (গাইডলাইন) খসড়া প্রণয়নের কাজ এগিয়ে নিয়েছে। সরকার তথা সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ নির্দেশিকা গ্রহণ ও অনুমোদন করার মাধ্যমে রোড ক্র্যাশসহ গতিজনিত অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমিয়ে আনতে পারে।

নিরাপদ ও মানসম্মত হেলমেটের ব্যবহার জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি ও ক্রমবর্ধমান। সেরকম পরিবেশে মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার খুবই জরুরি বিষয় বলে গণ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে যান্ত্রিক যত যানবাহন রয়েছে, তার প্রায় ৭২ শতাংশ হচ্ছে মোটরসাইকেল। কিন্তু দ্রুতগতি ও মানহীন বা অনিরাপদ হেলমেট মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।

প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফআইএ ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপ (জিআরএসপি) ও বিশ্বব্যাংক যৌথ উদ্যোগে ‘হেলমেট-নীতিনির্ধারক ও এ বিষয়ে কর্মরতদের জন্য ম্যানুয়াল’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, মানসম্মত হেলমেট সঠিকভাবে ব্যবহার করলে রোড ক্র্যাশে মারাত্মক আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি ২৮ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ কমে আসে এবং মাথায় আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি ৭৪ শতাংশ কমে আসে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ২০২২ সালে হেলমেটের মান নির্ধারণ করে একটি গাইডলাইন অনুমোদন করেছে, যা মানুষের জীবন বাঁচাতে কার্যকর। মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীকে নিজেদের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি কমাতে মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে, এ গাইডলাইন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পুলিশ, বিআরটিএ, বিএসটিআই প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সব মানুষেরই নিরাপদ সড়ক প্রাপ্য, এটা জীবনের জন্য অধিকার। আমরা যেমন অ্যারোপ্লেন ক্র্যাশকে ‘দুর্ঘটনা’ বলি না, তেমনি আমাদের রোড ক্র্যাশকেও দুর্ঘটনা বলা উচিত হবে না। যখন আমরা সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্বকে স্বীকার করব এবং রোড ক্র্যাশকে দেশের জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করব, তখন সংশ্লিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রত্যেক সড়ক ব্যবহারকারী সম্মিলিতভাবে একটি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ সবার জন্য নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

আমিনুল ইসলাম সুজন

কারিগরি পরামর্শক, সড়ক নিরাপত্তা, বাংলাদেশ, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস কৃষ্টি সাপোরিতো

উপ-পরিচালক, সড়ক নিরাপত্তা, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস, যুক্তরাষ্ট্র