রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বসছে কাঁটাতারের বেড়া: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা বাড়াতে ওয়াচ টাওয়ার, সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের নতুন একটি ইউনিটও মোতায়েন করা হবে।
গতকাল নিজের কার্যালয়ে বিদেশি কয়েকজন রাষ্ট্রদূত ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে চলতি মাসের শুরুর দিকে (৪ সেপ্টেম্বর) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমানে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও পাহাড়ি এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার অনুপস্থিতির কারণে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকরা ক্যাম্প ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর আলোকে ক্যাম্প এলাকায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কাঁটাতারের বেড়া/ওয়্যার ফেন্সি/সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা জরুরি প্রয়োজন।’
কাঁটাতারের বেড়ার বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিক জানতে চেয়েছিলেন জানিয়ে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এ কাজ শুরু হবে এবং কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেওয়া হবে। কাঁটাতার দিয়ে বেড়া নির্মাণ করা হলে জেলখানা হবে কি না এ রকম শঙ্কা তারা প্রকাশ করেছিল। আমি তাদের বলেছি, পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। টার্কি, সিরিয়ার শরণার্থী ক্যাম্প বিষয়ে সব উদাহরণ দিয়ে আমরা তাদের বলেছি।’
কাঁটাতারের বেড়া তৈরির কাজ কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাত্রই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে এনজিওকর্মীরা তাদের কর্মীদের ভিসার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন, যারা রোহিঙ্গাদের সেবা দিতে আসবেন, তাদের ভিসা আমরা সব সময় দিয়ে আসছি। কিন্তু ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা। আমরা দেখছি, তারা একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে, যুবলীগের এক নেতাকে খুন করেছে। প্রায়ই ক্যাম্পে মারামারি, হইচইসহ বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখছি।’
রাতে নিরাপত্তা বাহিনী রাস্তা ছাড়া আর কোথাও টহল দিচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, সেজন্য ওয়াচ টাওয়ারসহ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করব, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করব, যাতে করে তাদের অবস্থান সব সময় আমরা মনিটরিং করতে পারি। আমরা ওই প্রতিনিধিদলকে বলেছি, ক্যাম্পে থাকা অনেক রোহিঙ্গা এখনও মেইনল্যান্ড অর্থাৎ মিয়ানমারে যাতায়াত করে এবং তারা ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসছে। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো এসব যেন আর করতে না পারে এবং টেরোরিস্টদের নতুন করে কোনো ফায়দা না হয়। আর মানব পাচারকারীদের হাতে যাতে তারা না পড়ে।
কাঁটাতারের বেড়া হলে কোনো সমস্যা হবে না এমন আশ্বাসও প্রতিনিধিদলকে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শুধু রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে রাখতে চাই।’
এক প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের নতুন একটি ইউনিট হচ্ছে। এটা সিকিউর করার জন্য। বিজিবি ও র‌্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, যাতে করে আইনশৃঙ্খলা অটুট থাকে।’
পুলিশ সদর দফতর থেকে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৫৮৮ সদস্য নিয়ে গঠিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ১৪ ওই এলাকায় কাজ করছে। ওই ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে রয়েছেন একজন পুলিশ সুপার।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একটি বিশেষ ইউনিট হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর কবে হবে এ প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন, তিনি এসে যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবেই কাজ হবে। তবে এটি নির্ভর করে এখানে যারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওর প্রতিনিধি রয়েছেন, তাদের ওপর। প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্প করতে জায়গা চেয়েছেন এ বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তুরস্কে অনেক জায়গা আছে। তারা সেখানে নিয়ে গেলে আমরা সব সময় ওয়েলকাম করব। সৌদি আরবসহ সব দেশেই জায়গা রয়েছে। তারা যদি নিয়ে যায়, আমরা এপ্রিশিয়েট করব।’
এদিকে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে টেকসই উপায়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তৈরি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নরডিকসহ ইউরোপের চার দেশের রাষ্ট্রদূতরা।
দুবছর আগে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা সাত লাখসহ প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থলে পরিণত হওয়া কক্সবাজারে কয়েকটি শিবির পরিদর্শনের পর বুধবার এক যৌথ বিবৃতি দেন তারা।
তারা বলেছেন, প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানাতে ও সহায়তা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি পিটারসেন, নরওয়ের সিডসেন ব্লেকেন, সুইডেনের শারলোটা শ্লিটার ও সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেনে হোলেন্সটেইন একসঙ্গে বুধ ও বৃহস্পতিবার কক্সবাজার ঘুর আসেন। কক্সবাজারের স্থানীয়রাসহ বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক প্রয়োজনসহ সার্বিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় ভূয়সী প্রশংসা করেন তারা। এই সংকট মোকাবিলায় মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলো যেভাবে দুর্দান্ত কাজ করেছে, তারও প্রশংসা করেন তারা।
বিবৃতিতে তারা বলেন, জাতিসংঘ ও দেশি-বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মানবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো কক্সবাজারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে যা কেবল শরণার্থী জনগণের দুর্দশা লাঘবেই নয়, আয়োজকদের সহায়তার জন্যও।