শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে বিস্তৃতভাবে তিনটি স্বতন্ত্র যুগে ভাগ করা যেতে পারেÑপ্রাক-ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে আরাকান রাজ্য (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আরব থেকে মুসলিম নাবিক। এই সময়টা হলো ৭৮৮ থেকে ৮১০ খ্রিষ্টাব্দ; এরপর ১৫শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যে রয়েছে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা। এই সময়কালে রোহিঙ্গা ও আরাকানি বৌদ্ধরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিল। এই রাজ্যটিতে গড়ে ওঠে একটি স্বকীয় ধারার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তবে প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পর ১৮২৫ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের পর এই সম্প্রীতিতে দেখা যায় ধর্মীয় বিভাজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়, যখন রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা করে, যখন আরাকানি বৌদ্ধরা জাপানিদের পক্ষ নেয়। এই আনুগত্য পরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ পরিণতি ঘটে, যারা বার্মা জাপানি দখলের সময় ব্যাপক সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, যেখানে আনুমানিক এক লাখ মানুষ নিহত ও ৫০ হাজার মানুষ পূর্ব বাংলায় নির্বাসনে বাধ্য হয়।
মগেরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর রোহিঙ্গারা মুসলিম। তবে ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা প্রদেশটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওয়াফা এ রাজ্য দখল করে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে সমগ্র মিয়ানমার অর্থাৎ তৎকালীন বার্মা ব্রিটিশ শাসনাধীন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা তৎকালীন বার্মায় বর্তমান মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে, আর সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে রোহিঙ্গাদের নাম। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে রোহিঙ্গা সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছিল রোহিঙ্গাদের দ্বারাই। ১৯৪৬ সালে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের নির্দেশনানুযায়ী বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের জয়কে স্বাগত জানাতে পারে আরাকানের বৌদ্ধরা। সেই ধারণার আলোকে ব্রিটিশরা ১০ মাইলের একটি বাফার জোন নির্দিষ্ট করে এবং সেখানকার অভিবাসী রোহিঙ্গাদের লেলিয়ে দেয় বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে। কথিত আছে যে, এক সপ্তাহের রোহিঙ্গা নৃশংসতায় প্রায় ১০ হাজার বৌদ্ধ নিহত হন, ব্রিটিশ প্ররোচনায় রোহিঙ্গা জনপদকে প্রথমে এভাবেই রক্তের প্রান্তর গড়ে তোলে রোহিঙ্গারাই। এই রক্তাক্ত হাঙ্গামায় বৌদ্ধদের হাতে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। আর এভাবেই দুই ধর্মপালনকারী জনগোষ্ঠীর মাঝে বিবাদের সূত্রপাত শুরু যা আজও বিদ্যমান। ওই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার সংঘর্ষের বীজ ব্রিটিশরাই রোপণ করে রেখে যায়, যা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার পর বার্মা বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও এই যাত্রা থেমে যায়। গণতন্ত্রের আমলে মিয়ানমারের পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। নে উইন গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেয়। ব্রিটিশদের করা ১৩৯টি জাতিগত সম্প্রদায়ে রোহিঙ্গাদের নাম না থাকায় তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে নেয় সামরিক জান্তা। ১৯৪৬ সালের ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের দুই গ্রুপে বারবার সংঘর্ষ হতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতি সংখ্যার অধিবাসীরা নানা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। কারও কারও মতে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর অন্যতম নিগৃহীত জনগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব হারায়। তারা নিজভূমে হয়ে যায় কারাবন্দি। সরকারের অনুমোদন ব্যতীত রোহিঙ্গারা ভ্রমণ করতে, আর দুটির অধিক সন্তান জন্ম দিতে পারবে না বলে আইনও হয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নেউইন ক্ষমতা দখলের পর থেকেই এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। রাখাইন অঞ্চলে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী উগ্রবাদ গতি লাভ করে, যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করে তোলে। ১৯৭৮ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন বার্মিজ সামরিক জান্তা অবৈধ বাসিন্দা বলে বিবেচিত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করার জন্য একটি বৃহৎ পরিসরে অভিযান শুরু করে, যার ফলে ব্যাপক হয়রানি, সহিংসতা ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে। এর ফলে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা গণহত্যায় প্রাণ হারায়। প্রায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় পরের বছর বার্মা ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বার্মায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মাত্র তিন বছর পরে ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। উত্তর রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক আট লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। শতাব্দী ধরে বার্মায় রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বার্মিজ সরকার তাদের পরিচয় অস্বীকার করে চলেছে। রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না মিয়ানমার। পরিবর্তে তাদের বাঙালি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে।
রোহিঙ্গা সংঘাত শুরু হয় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে (পূর্বে আরাকান, বার্মা নামে পরিচিত) একটি চলমান সংঘাত। রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। আর এই সহিংসতায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সামরিক অভিযান, যা রাষ্ট্রীয়ভাবে রোহিঙ্গা নিধনের অভিযান। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বুথিডং, মংডু ও রাথেডং টাউনশিপ এলাকা মিয়ানমার বাহিনীর হামলা দ্বারা চিহ্নিত।
রোহিঙ্গা দাঙ্গা ১৯৪৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ বছরের বিবদমান একটি সমস্যা। অনেকের মতে, এই দীর্ঘদিনের সমস্যাটিতেও বর্তমানে নব্য সৃষ্ট বিদেশি কোনো গোষ্ঠী ঈন্ধন দিচ্ছে। ২০১৬ সালে দেশের বেশ কয়েকটি ইসলামিক রাজনৈতিক সংগঠন সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল সীমান্ত খুলে দিতে। বাংলাদেশের পক্ষে কি এই রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়া সম্ভব? যেসব রোহিঙ্গা ভিন্ন পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বাস করছে, সেই রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে অভিযোগ আছে যে, তারা নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত। বাংলাদেশর অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলাও বিনষ্ট হচ্ছে আগত এই রোহিঙ্গাদের কারণে।
রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান বলে উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ইফতার করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কদিন পর বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, যার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডোর।
এই মানবিক করিডোরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিবও ‘করিডোর’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি মানবিক চ্যানেল ব্যবহার করেছেন, যা একেবারেই আলাদা,’ বলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, ‘রাখাইনে কোনো ধরনের মানবিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য উভয় পক্ষের সম্মতি আবশ্যক।’
আরাকানকে করিডোর দেয়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে আত্মঘাতী।’
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মানবিক করিডোরের প্রস্তাব জাতিসংঘ থেকে আসুক অথবা আমেরিকা থেকে আসুক, তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ইতিহাস বলে, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কঙ্গো অথবা সিরিয়া-কোথাও মানবিক করিডোরের বাস্তবায়ন সফল হয়নি। ইউক্রেন-রাশিয়ায় জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে করিডোরের সিদ্ধান্তটি নেয়া দরকার।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী, মুক্ত লেখক
কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী