রোহিঙ্গা সংকট: মানবিক করিডোরের সম্ভাবনা, সাফল্য ও ঝুঁকি

মিথিলা খাতুন : বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা বহন করে আসছে। ২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম বড় একটি মানবিক সংকট। তবে সম্প্রতি জাতিসংঘ আরাকান অচঞ্চলের তীব্র মানবিক সংকটের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ মানবিক করিডোর স্থাপনের কথা বলেছে জাতিসংঘ। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে বাংলাদেশের সরকারও নাকি নীতিগতভাবে এই বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত শুধু মানবিক সহায়তার প্রশ্ন নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মানবিক করিডোর হলো কোনো দুর্যোগ কবলিত বা সংঘাতপূর্ণ এলাকার মধ্য আটকেপড়া বেসামরিক জনগণের মধ্যে খাদ্য, চিকিৎসাসেবা প্রভৃতি পৌঁছে দেয়া বা অন্য স্থানে তাদের সরিয়ে নেয়ার একটি সুযোগ তৈরি করা। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সম্মতি ও সহযোগিতা আবশ্যক।

মানবিক করিডোরের ধারণা বিংশ শতাব্দীর শুরু অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই গড়ে ওঠে। ১৯৩৮-৩৯ সালে জার্মানির নাৎসি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তরের ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’ ছিল এক প্রকার মানবিক করিডোর। পরবর্তীকালে বসনিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে এই করিডোর ব্যবহার হয়েছে বেসামরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তবে এর অতীত ও বর্তমান কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে এই মানবিক করিডোরের ফলাফলের জটিলতার দিক বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

যেমন- ১৯৮৯ সালে প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য লাচিন করিডোর স্থাপিত হয়েছিল। এটি নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিডোর বা ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও বছর দুয়েকের মাঝেই করিডোরটি আজারবাইজান বন্ধ করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছিল; যদিও আর্মেনিয়া ও তার মিত্র প্রজাতন্ত্রগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। তাছাড়া বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মানবিক করিডোরের ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। সেখানেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবিক করিডোর।

২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার মানবিক করিডোরের কথা বলা যায়, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার কর্মকর্তারা একটি মানবিক করিডোরের বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন যার লক্ষ্য ছিল সংঘাতময় এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে সহায়তা করা। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেল মানবিক করিডোরের সংখ্যা ছিল সীমিত। আবার কোনো সময় কোনো করিডোর ব্যবহার করা যাবে এমন তথ্যগুলোও আসছিল শেষ সময়ে। ফলে বেসামরিক নাগরিকদের তা ব্যবহার করার সুযোগ কম ছিল। বরং করিডোর ব্যবহারের সময় বিশেষ করে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে বেসামরিক মানুষ চেকপোস্টগুলোতে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া কারা এই করিডোরের অনুমতি দেবে তা নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছিলো।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষকে করিডোর ব্যবহার করে নিরাপদ এলাকার দিকে যাওয়ার জন্য কয়েক দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। এমনকি এমন মানুষদের বহনকারী একটি কনভয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পর্যন্ত হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, মানবিক করিডোরের সফল বাস্তবায়ন কেবল সদিচ্ছার ওপর নয়, বরং কূটনৈতিক দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও পরিস্থিতির ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে।

আবার সম্প্র্রতি বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর স্থাপনের বিষয়ে যে নীতিগত স্বীকৃতির কথা জানিয়েছেন, তাকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন ওঠে, যেমন: বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমারের সীমান্ত আছে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড এবং লাওসের সঙ্গে। এছাড়াও সিতর বন্দরসহ নানা বিকল্প ব্যবস্থা। তাহলে শুধু বাংলাদেশ কেন? আবার, এই করিডোর কি কেবল শুধুই মানবিক, নাকি এর মাধ্যমে অন্য কোনো ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও বাস্তবায়িত হবে? তাছাড়াও রাখাইন রাজ্য চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্বার্থ জরিত থাকায় কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। সেক্ষেত্রে চীন এই করিডোর নিয়ে কী অবস্থান নেয়, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। এছাড়াও এই অঞ্চলের গ্যাস, খনিজ সম্পদ এবং সমুদ্রবন্দর বিশ্বের অনেকের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে বড় প্রশ্ন হলো, এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে? যদি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বিদেশি শক্তি এর নিয়ন্ত্রণ নেয়, তবে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। করিডোরের আড়ালে যদি অস্ত্র পাচার বা উগ্রপন্থিদের চলাচল ঘটে, তবে তা হবে জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি হবে।

বিশ্ব ইতিহাসে মানবিক করিডোরের আড়ালে অস্ত্র পাচারের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালে মানবিক সহায়তার ছদ্মাবরণে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। ২০১৫ সালে তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা (গওঞ) দ্বারা পরিচালিত ট্রাকে অস্ত্র পাচারের প্রমাণ ঈঁসযঁৎরুব : পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ওঠে আসে। বসনিয়া যুদ্ধেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ও মানবিক সহায়তা বাহিনীর ছত্রছায়ায় বেসামরিক রসদের সঙ্গে অস্ত্র পাচারের অভিযোগ ছিল। লেবাননের গৃহযুদ্ধ ও গাজার ভূখণ্ডেও মানবিক সহায়তার পথে অস্ত্র প্রবেশের ঘটনা দেখা গেছে, ফলে এই করিডোরগুলোর নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, মানবিক করিডোর যতটা সম্ভাবনার, ততটাই জটিল ও নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ, যদি না কঠোর নজরদারি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়।

এছাড়াও সম্প্রতি আরাকান আর্মির সদস্যদের জলকেলি উৎসকে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চলে আনাগোনা এবং জনসভার আবেগঘন বক্তব্য দেয়া, এসব ঘটনা উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেই। তাই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, করিডোর তৈরি করা হলে হলে তা হতে পারে অত্যন্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো এই মানবিক করিড়োরের মাধ্যমে কি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আসবে? বাস্তবতা হলো, বর্তমানে রাখাইনের ৯০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জান্তা সরকারের মতোই। নির্যাতন, উচ্ছেদ এখনও চলছেই। নভেম্বর ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে করিডোর হলেও, এই সংকট থেকে বাংলাদেশ বের হওয়ার পথ এখনও পরিষ্কার নয়।

মানবিক করিডোর শব্দটি যতটা আবেগময় ও সহজ কিন্তু বাস্তবতা ঠিক ততটাই কঠিন। মানবতা দেখানোর আড়ালে অনেক সময়ই এ ধরনের করিডোর পরিণত হয় শক্তির খেলা, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব কিংবা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কৌশলে। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদ ও কৌশলগত সংকটে থাকা একটি রাষ্ট্রের পক্ষে, এই করিডোরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি সম্ভাব্য ফাঁদ সম্পর্কে আগে থেকে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। যদি মানবিক করিডোর বানানোর ব্যাপারে গৃহীতা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সেটি কেবল মানবতার প্রশ্নে নয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে মানবতা দেখাতে গিয়ে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎকেই ঝুঁকির মুখে পরতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে হেনরি কিসিঞ্জারের সেই তীক্ষ্ণ উপলব্ধিটিই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ঈড়ঁহঃৎরবং ফড়হ’ঃ যধাব ঢ়বৎসধহবহঃ ভৎরবহফং ড়ৎ বহবসরবং, ড়হষু রহঃবৎবংঃং. মানবিক করিডোরের মতো আবেগনির্ভর উদ্যোগেও তাই রাষ্ট্রের স্থায়ী স্বার্থকেই প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।