লকডাউনের কার্যকর বিকল্প কী?

জিয়া উদ্দিন মাহমুদ: নভেল করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা এখনও শেষ না হলেও সাধারণ জনগণের অভিজ্ঞতাও কম হয়নি। গত বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কভিড পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম প্রভৃতি বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় জীবনযাত্রাকে নতুন স্বাভাবিক থেকে অনেকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছিল। কভিড পরিস্থিতিও চলে এসেছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। যদিও শীতকালে বাংলাদেশে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে একই সঙ্গে আশঙ্কা ও প্রস্তুতি দুটোই ছিল কিন্তু সেই আশঙ্কাকে স্তিমিত করে হঠাৎ অনেকটা পূর্বাভাস ছাড়াই বিগত কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিকভাবে কভিড আক্রান্ত ও প্রাণহানি দুটোই বাড়তে শুরু করেছে। অনেকটা ফাঁকা থাকা কভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোতে এখন তৈরি হয়েছে আসন সংকট। অনেকটাই স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় কভিডের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকার সারাদেশে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে, যা এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘন বসতির দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনবসতি প্রায় ১ হাজার ২৪০ জন কিন্তু ঢাকা মহানগরের এই হার প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৩ হাজার ২৩৪ জন আর চট্টগ্রাম মহানগরে প্রায় ১৯ হাজার ৮০০ জন। দৈব কোনো কিছু না ঘটলে এ ধরনের ঘনবসতি স্থানে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবেই। কারণ মানুষকে বাধ্য না করলে জীবিকার প্রয়োজনে হোক অথবা অন্য যে কোনো প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে মানুষ বের হবেই। এই মুহূর্তে সংক্রমণের হার (এখন ২২ শতাংশের ওপরে) যেহেতু আশঙ্কাজনক, তাই এখনই মানুষের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হতে পারে। আর তাই মানুষের চলাচল ও কভিড নিয়ন্ত্রণ  করার জন্যই এই ‘লকডাউন’। কারণ সংক্রমণ যদি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন লকডাউনেও কোনো কাজ হবে না। যার দুর্ভোগ বইতে হচ্ছে ব্রাজিলকে। এমন দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল ইতালিও। কিন্তু লকডাউনের ফলে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও নাগরিক দুর্ভোগ তৈরি হয়, তা কভিডের চেয়েও ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী। নাভিশ্বাস তৈরি হয় স্বল্প আয়ের মানুষের ও দিনমজুরদের। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যার ফলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গত বছরে কভিডের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটাতে সরকার প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা জিডিপির প্রায় ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ কিন্তু তারপরও অর্থনৈতিক গতি স্বাভাবিক হতে পারেনি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কভিডের কারণে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এ অবস্থায় কভিডের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন আমাদের দেশের মতো অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ এবং এটি কোনো স্থায়ী সমাধানও নয়। কারণ কভিডকে অতি দ্রুত একেবারেই নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই লকডাউনের বিকল্প হিসেবে সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও অর্থনৈতিক গতি এই দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কভিড হচ্ছে একটি দৈব ঘটনা (অপঃ ড়ভ মড়ফ), যার ওপর কারও হাত নেই। আর যেহেতু এই রোগ যে কোনো সময় মহামারি আকার ধারণ করে, তাই আমরা যত ব্যবস্থাই নেই না কেন আমাদের কিছু না কিছু অর্থনৈতিক ক্ষতি হবেই, যা মেনে নিতেই হবে। তাই কভিডকালে সার্বিক অর্থনীতি গতিশীল রাখতে এবং একই সঙ্গে কভিড নিয়ন্ত্রণে রাখতে লকডাউনের বিকল্প হিসেবে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

ক. যেসব অফিসে ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্ভব, সেসব অফিসে তা পুনরায় চালু করা এবং সরকার ঘোষিত বৃদ্ধ, অসুস্থ ও গর্ভবতীদের বাসা থেকে অফিস কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা কার্যকর করা। খ. বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান ছাড়া) সাপ্তাহিক কার্যদিবস ৫ দিন বা ৬ দিন থেকে কমিয়ে ৩-৪ দিন করা এবং কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ৬ ঘণ্টা করা। অফিস শুরু ও ছুটির সময় পরিবর্তন করে ১০টা থেকে ৪টা করা। গ. বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেখানে সেবাপ্রার্থীদের উপস্থিতির প্রয়োজন সেসব প্রতিষ্ঠানে শুধু জরুরি বিভাগ ছাড়া অন্যান্য বিভাগের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা বা কমানো। সেবাপ্রাপ্তির সময় কমানোর জন্য কার্যকরী পন্থা চালু করা। যেমন ব্যাংকে নগদ জমা-উত্তোলন, ক্লিয়ারিং, বৈদেশিক রেমিট্যান্স ও আমদানি-রপ্তানি ব্যতিরেকে অন্যান্য কাজ নিরুৎসাহিত করা। গ্রাহকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সেবা নিতে অভ্যস্ত করা। এতে গ্রাহকের চাপ যেমন কমবে, তেমনি অল্প সংখ্যক কর্মী দিয়ে কার্যক্রম চালানো যাবে। ঘ. এই সময়টায় দিন বড় ও রাত ছোট থাকে। তাই শিল্প-কারখানাগুলো বিশেষত রপ্তানি শিল্পগুলো তাদের উৎপাদন কার্যক্রম সকাল ৭টা থেকে শুরু করতে পারে এবং ৩টায় বন্ধ করতে পারে। এতে রাস্তাঘাটে একই সময়ে বিভিন্ন কর্মজীবীদের চাপ কমবে। কারখানাগুলো রোটেশনের ভিত্তিতে ৭০-৮০ শতাংশ কর্মী দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চালানোর ব্যবস্থা নিতে পারে। এতে কারখানার কাজেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। এছাড়া শিল্পাঞ্চলগুলোয় সব কারখানার জন্য একইদিন সাপ্তাহিক ছুটি না রেখে বিভিন্ন কারখানার ছুটি আলাদা আলাদা দিনে করতে পারে, এতে শিল্পাঞ্চলগুলোয় লোক সমাগম কিছুটা কমবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটি যৌক্তিকভাবে বাড়ানো যেতে পারে। ঙ. আদালতগুলোয় আগের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ মামলা ছাড়া আপাতত অন্যান্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখা এবং কার্যক্রম ভার্চুয়ালি চালানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আদালতে অপ্রয়োজনীয় মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চ. দোকানপাট-শপিংমলগুলো (নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান ছাড়া) সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে আপাতত আরও একদিন বা দুদিন বন্ধ রাখা যেতে পারে এবং বিকাল ৫টার পর সব বন্ধ রাখা যেতে পারে। ছ. কাঁচাবাজার পূর্বের ন্যায় খোলা মাঠে ব্যবস্থা করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে কড়াকড়ি করা। সুপার শপ ও বিভিন্ন শোরুমগুলোয় একসঙ্গে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ প্রবেশে কড়াকড়ি করা। বিকল্প হিসেবে অনলাইনে বিক্রয় ও হোম ডেলিভারি ব্যবস্থা চালু করতে উৎসাহিত করা। জ. রেস্টুরেন্টগুলোয় সরকার ঘোষিত ৫০ শতাংশ ক্রেতার উপস্থিতি মানাসহ সন্ধ্যা ৬টার পর শুধু রাতের খাবার (ভাতসহ অন্যান্য) ছাড়া অন্যান্য খাবার আপাতত বন্ধ রেখে রাত ৯টার পর বন্ধ রাখা যেতে পারে। অন্য যে কোনো ধরনের রেস্টুরেন্ট ৬টার পর বন্ধ রাখতে হবে। ঝ. প্রয়োজন ব্যতিরেকে বিভিন্ন জেলায় মানুষের যাতায়াত নিরুৎসাহিত করা। এজন্য আন্তঃজেলা বাসের সংখ্যা সীমিত করা উচিত, এতে মানুষ অতি প্রয়োজন ছাড়া চলাচলে নিরুৎসাহিত হবে। ঞ. ব্যক্তিগত বা ভাড়ায় চালিত গাড়িতেও গণপরিবহনের মতো স্বল্প সংখ্যক যাত্রী চলাচলে বাধ্য বাধকতা করা। ট. জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সচেতনতার পাশাপাশি জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো এবং এ-সংক্রান্ত দৃষ্টান্তমূলক প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে। ঠ. অপ্রয়োজনে রাস্তায়, দোকানে বা অন্য কোনো স্থানে আড্ডা বা গণজমায়েত নিষিদ্ধ করতে হবে। জনসমক্ষে ধূমপান বন্ধ রাখতে হবে। ড. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদিসহ বিভিন্ন পণ্যের পরিবহন ও সরবরাহ দিনের পরিবর্তে রাতে করা যেতে পারে। ঢ. স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া উচিত। প্রয়োজনে সপ্তাহে ২ দিন ক্লাসভিত্তিক ও বাকিদিনগুলো দূরশিক্ষণ (অনলাইন) অর্থাৎ উভয় পদ্বতি চালু রাখা যেতে পারে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব এই ধরনের বড় স্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের গণপরীক্ষাগুলোর আয়োজন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় একাধিক পরীক্ষার হল ব্যবহার করা যেতে পারে। 

লকডাউনের বিকল্প হিসেবে যে ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন, মূল উদ্দেশ্য রাখতে হবে মানুষের চলাচল যাতে সীমিত হয়। আর যে কোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার সর্বাত্মক সহযোগিতাসহ ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। করোনা নির্মূলে সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানা আমাদের সবার নাগরিক দায়িত্ব। সেই সঙ্গে সরকারের টিকা কার্যক্রম, চিকিৎসার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশব্যাপী স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক উন্নয়নসহ করোনার ফিল্ড হসপিটালগুলোর কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। সরবরাহের অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদির দাম যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকেও সরকারকে কঠোর নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজে করোনামুক্ত থাকলে আপনার পরিবারও সুরক্ষিত থাকবে আর পরিবার সুরক্ষিত থাকলে সমাজ-দেশ সুরক্ষিত থাকবে।

ব্যাংকার ও  মুক্ত লেখক

ziauddin24@gmail.com