লকডাউনে বিপর্যস্ত সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প

শরীফুল ইসলাম ইন্না, সিরাজগঞ্জ: মহামারি কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত ধারাবাহিক লকডাউনের ফলে চলতি বছর ও গত বছর বর্ষবরণ এবং ঈদুল ফিতরকে উপলক্ষ করে উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করতে না পেরে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তাঁতকুঞ্জ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

লকডাউনে সাপ্তাহিক কাপড়ের হাটগুলোয় ক্রেতা আসতে না পারায় অবিক্রীত রয়ে যাচ্ছে মহামারির অজুহাতে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া উপকরণে উৎপাদিত তাঁতপণ্য। ফলে অর্থসংকটে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ছেন তাঁত শ্রমিকরা।

সিরাজগঞ্জ সদরসহ বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলায় হস্ত ও মেশিনচালিত প্রায় পাঁচ লাখ তাঁত রয়েছে। শিল্পটির ওপর জীবিকা নির্ভরশীল জেলার প্রায় চার লাখ পরিবারের ১৫ লাখ মানুষের। সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প বাঁচাতে সরকার প্রয়োজনীয় প্রণোদনাসহ অবিক্রীত তাঁতপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা না করলে লাখো মানুষের রুটি-রুজির এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে জানালেন জনপ্রতিনিধি ও ব্যাবসায়ী নেতারা। শিল্পটি রক্ষায় সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা সম্পৃক্তদের।

দেশীয় তাঁতে তৈরি পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে পয়লা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরে। এই মৌসুম দুটির চাহিদা পূরণেই সারাদিন খটখট শব্দে চলে কাপড় বোনার কাজ। গত বছর বৈশাখের কয়েক দিন আগেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। লকডাউনে সরকার বন্ধ করে দেয় দোকানপাট, বাতিল হয়ে যায় নববর্ষ ও ঈদুল ফিতরের সব আয়োজন। ফলে বড় ধরনের লোকসানে পড়েন ব্যবসায়ীরা। এক বছর পর এসে সেই লোকসান কাটিয়ে উঠতে এবার আবারও উৎসব দুটি উপলক্ষে পণ্য তৈরি করেছিলেন সিরাজগঞ্জের তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা, কিন্তু বিধি বাম। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় এবারও সরকারের কঠোর লকডাউনে মাথায় হাত তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীদের।

মহামারির অজুহাতে চীন থেকে আসা সুতা ও রঙের দাম বেড়েছে দেড়গুণ। তারপরও কারখানা চালু রাখতে শাড়ি ও লুঙ্গি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছিলেন কারখানা মালিকেরা। কিন্তু উপর্যুপরি লকডাউনে হাটে ব্যাপারীরা আসতে না পারায় উৎপাদিত তাঁতপণ্য অবিক্রীত থেকে যাওয়ায় নগদ অর্থ পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে মালিকদের। ফলে বাধ্য হয়ে একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে তাঁত কারখানা। এতে বেকার হয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা।

তাঁত শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লকডাউনের কারণে মহাজনরা কাপড় বিক্রি করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে বিপদে আছি। কোনোমতে দিন চলছে আমাদের। বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক শ্রমিক। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।

বেলকুচি উপজেলা হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক হাজী মেজবাহ বলেন, চলমান লকডাউনে তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় হাটে পাইকাররা আসতে পারছেন না। এ কারণে উৎপাদিত কাপড় বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুনতে হচ্ছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ছেন। সরকার সহযোগিতা না করলে একে একে বন্ধ হয়ে যাবে তাঁত কারখানা।

বেলকুচি পৌরসভার মেয়র সাজ্জাদুল হক রেজা বলেন, শুধু বেলকুচি নয়, পুরো সিরাজগঞ্জ জেলা তাঁতশিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত। কভিডকালে প্রথম ধাপে শ্রমিক মালিককে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। প্রকৃত তাঁতিরা যেন সরকারি প্রণোদনা পান, সে বিষয়ে বেলকুচি পৌরসভার পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জকে তাঁতকুঞ্জ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এখানে অনেক তাঁতশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে তিন লাখ শ্রমিক জড়িত রয়েছেন। প্রথম দফা করোনা সংক্রমণের সময় তারা যে কাপড় তৈরি করেছিল তা বিক্রি করতে পারেনি। করোনা মহামারির কারণে এবারও একই অবস্থা। হাটবাজার ও দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে তাঁতশিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন তাঁত মালিক ও শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান দিয়ে শিল্পটাকে বাঁচান।