লক্ষ্মীপুরে গড়ে উঠছে ছোবড়া প্রক্রিয়াকরণের কারখানা

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: নারকেলের ছোবড়া প্রক্রিয়াজাত করে বছরে ৫০ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা হয় লক্ষ্মীপুরে। আগে নারকেলের ছোবড়া শুধু জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এখন শুধু ছোবড়াই নয়, ছোবড়ার গুঁড়া বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এমনটিই জানালেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালালবাজার এলাকার ছোবড়া ব্যবসায়ী আবদুর রহিম।

লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, জেলায় নারকেল বাগান ও বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি শুকনো নারকেল আহরণ করা হয়। প্রসেসিং কারখানাগুলোয় শুকনো নারকেলের ছোবড়া থেকে শৌখিন পণ্য তৈরির প্রধান উপাদান কোকো ফাইবার বা আঁশ এবং ছোবড়ার গুঁড়া থেকে প্রাণীর খামার তৈরির অন্যতম উপাদান কোকোডাস্ট তৈরি করা হয়।

জানা যায়, শৌখিন পণ্য তৈরির প্রধান উপাদান কোকো ফাইবার ও মাটিবিহীন ছাদ বাগান, নার্সারির গাছ বপন, পশু ও পোলট্রি খামার তৈরির অন্যতম উপাদান কোকো ডাস্ট। কোকো ডাস্ট নারকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি করা হয়। লক্ষ্মীপুরে এখন বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার কোকো ফাইবার ও ডাস্ট উৎপাদিত হয়। বর্তমানে নতুন এ দুটি পণ্যের চাহিদা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কারখানাগুলো পণ্য উৎপাদন করার আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

একসময় স্থানীয় বাজারগুলোয় শুধু নারকেল কেনাবেচা হলেও এখন জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, সদর উপজেলার দালাল বাজার, জকসিন, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া, মীরগঞ্জ, সোনাপুর, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, রামগতির আলেকজান্ডার ও জমিদারহাটে ছোবড়া প্রসেসিং কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ৩০টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় নারী-পুরুষ মিলে কমপক্ষে ১০-১৫ শ্রমিক কাজ করেন।

সদর উপজেলার জকসিন এলাকার ছোবড়া কারখানা শ্রমিক কামাল জানান, আগে নারকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে জাজিম, পাপোশ, রশি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হতো। বেডিং শিল্পেও ছোবড়ার ব্যবহার ছিল। আর ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া পাওয়া যেত, তা কোনো কাজে লাগত না। কিন্তু এখন কোকো ফাইবার নামে ছোবড়ার আঁশ এবং কোকো ডাস্ট নামে ছোবড়ার গুঁড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের নারকেল ব্যবসায়ী কামরুল হোসেন জানান, নারকেল থেকে ছোবড়া আলাদা করে শুধু নারকেল বিক্রি করতাম। ছোবড়া বর্জ্য হিসেবে খালে ফেলে দেয়া হতো। এতে খালে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। এখন ছোবড়াকে প্রক্রিয়াজাত করলে বেশ লাভবান হওয়া সম্ভব। দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোবড়া প্রক্রিয়াজাতের সম্ভাবনাময় শিল্প গড়ে উঠেছে। প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন কয়েক টন ছোবড়াকে আঁশে পরিণত করা হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর ছোবড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোবড়া থেকে মেশিনের সাহায্যে বের করা হয় আঁশ বা ফাইবার। ছোবড়া সংখ্যা হিসেবে ক্রয় করা হয়। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় কমপক্ষে ৮০ কেজি আঁশ বা ফাইবার পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, প্রতিটি কারখানা থেকে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফাইবার বিক্রি করা হয়। এতে বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা।

সদর উপজেলার দালাল বাজার এলাকার ছোবড়া ব্যবসায়ী সততা ট্রেডার্সের মালিক মো. জাকির হোসেন জানান, বর্তমানে ছোবড়ার আঁশ বা ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা। মানভেদে প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া পাঁচ-সাত টাকায় কেনা হয়। ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির পর প্রতি ২০ কেজি ওজনের একটি ফাইবার বান্ডেল বিক্রি করেন ৫০০-৬০০ টাকা দরে। প্রতিটি কারখানায় সপ্তাহে চার থেকে ছয় ট্রাক ফাইবার উৎপাদন হয়। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ২০০ বান্ডিল ফাইবার বহন করে। তিনি আরও জানান, সব খরচ বাদে এক একটি কারখানায় মাসে ৫০ হাজার টাকারও বেশি আয় হয়ে থাকে।

শহরের নার্সারি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া বের হয়, তা শাকসবজি চাষের সময় ও ছাদবাগানে কাজে লাগে। চারা উৎপাদনের জন্য এখন মাটির পরির্বতে কোকো ডাস্ট খুবই জনপ্রিয়। এক হাজার নারকেলের উপজাত হিসেবে বের হয় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া বা কোকো ডাস্ট। ২০ কেজির প্রতি বস্তা কোকো ডাস্ট ১৪০-১৬০ টাকায় পাইকারি কিনে আনেন তিনি।

এদিকে নারকেল ছোবড়া থেকে লক্ষ্মীপুরে অনেকগুলো কারখানা তৈরি হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও কারিগরি সহায়তা পেলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটাতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।