নিয়াজ মাহমুদ: দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানত ও মুনাফাসহ অধিকাংশ সূচকেই এগিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর থেকে শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে ব্যাংকটি। তবে আগের দুই বছরের তুলনায় ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ শেষ হওয়া অর্থবছরে মুনাফা বাড়লেও লভ্যাংশের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যাংকটিকে আরও সুসংহত করতেই লভ্যাংশে এ কৃচ্ছ্র সাধন করা হয়েছে বলে দাবি ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের।
বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংকের ২৪৩তম বোর্ড সভা সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী বছরে শেয়ারহোল্ডারদের মাত্র ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন সৌদি আরবের আল রাজি গ্রুপের প্রতিনিধি। তবে পর্ষদের অধিকাংশ সদস্য তার পক্ষে সায় না দেওয়ায় চূড়ান্তভাবে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ অনুমোদন করে বোর্ড, যা ২৩ মে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অনুমোদন করা হবে। আর এজন্য রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা
হয়েছে ২৩ এপ্রিল।
১৯৮৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম লভ্যাংশ দিয়েছে গত বছর। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিদায়ী বছরের তুলনায় মুনাফা কমলেও লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫ এবং ২০ শতাংশ। ২০১৫ অর্থবছরের তুলনায় গত বছর শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমেছে।
মুনাফা বাড়লেও লভ্যাংশ কম দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে গতকাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের ব্যাংক দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক। আমরা বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে সবসময় প্রস্তুত। বেশি লভ্যাংশ দিলে বেশি আয় করা সম্ভব না। ব্যাংকটিকে আরও সুসংহত করতেই লভ্যাংশ গত বছরের তুলনায় কম দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১৫ সালে ব্যাংকটির মুনাফা কম হলেও তখনকার পর্ষদ রিজার্ভ ভেঙে শেয়ারহোল্ডারদের বেশি লভ্যাংশ দেয় বলে দাবি করেন সাবেক এ আমলা।
লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ কমে যাওয়ার কোনো প্রভাব ব্যাংকটির শেয়ারদরে পড়বে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারদরে ইতিবাচক প্রভাব না পড়লেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে আমার ধারণা। মূলত, শেয়ারদর ওঠানামা করে বিনিয়োগকারীদের পারসেপশনের (ধারণা) ওপর ভিত্তি করে। চলতি বছরের শুরুতে আমরা যখন দায়িত্ব নিই তখনও তো শেয়ারদর বেড়েছে। যদিও অনেকে বলেছে শেয়ারদর হ্রাস পাবে। আমাদের পর্ষদের সব সদস্যই অত্যন্ত পেশাদার। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই ব্যাংকটিকে সুসংহত করতে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে একটি সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমিয়ে একটি শ্রেণি ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই শ্রেণিটির তদবিরেই পর্ষদ লভ্যাংশের পরিমাণ কমিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম কমবে। তখন ওই শ্রেণিটি ব্যাংকটির শেয়ার কিনবে। এমনকি ন্যূনতম শেয়ার ধারণ করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হবেন বলেও জানা গেছে।
ব্যাংকটির একাধিক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিজকে বলেন, নতুন পর্ষদ ব্যাংকটির লভ্যাংশ পলিসি ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ কিছুই বিবেচনায় নেয়নি। এ ঘোষণা এক দিকে ব্যাংকটির বিনিয়োগকারীদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করবে তেমনি উদীয়মান পুঁজিবাজার পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে প্রতিনিয়ত বলা হয়, দেখে শুনে ভালো ফান্ডামেন্টাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন। ফান্ডামেন্টাল দেখে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার পরেও যদি কোম্পানির হটকারী সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন তবে বিএসইসিকেই প্রতিকারের দায়িত্ব নিতে হবে।
ব্যাংকটির প্রকাশিত মূল্যসংবেদনশীল তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ শেষ হওয়া বছরে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে এককভাবে ২ টাকা ৭৭ পয়সা আর সমন্বিত ইপিএস ২ টাকা ৭৮ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে ব্যাংকটির এককভাবে ইপিএস ছিল ২ টাকা ৪ পয়সা এবং সমন্বিত ইপিএস ২ টাকা ৪ পয়সা। গত বছরের তুলনায় ব্যাংকটির ইপিএস ৩৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিদায়ী বছরে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদমূল্য (এনএভি) হয়েছে এককভাবে ৩০ টাকা ২৭ পয়সা এবং সমন্বিতভাবে ৩০ টাকা ৩৪ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে এককভাবে এনএভি ছিল ২৯ টাকা ৪৮ পয়সা এবং সমন্বিত ২৯ টাকা ৫৪ পয়সা। একই সঙ্গে নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো বা নগদ কার্যকর প্রবাহ শেয়ারপ্রতি এককভাবে হয়েছে (ঋণাত্মক) ৬ টাকা ৭৭ পয়সা এবং সমন্বিত (ঋণাত্মক) ৬ টাকা ৮১ পয়সা। এর আগের বছর ছিল এককভাবে ৭ টাকা ২০ পয়সা এবং সমন্বিত ৮ টাকা ৮৪ পয়সা।
ইসলামী ব্যাংকের গত বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর, ২০১৬) ইপিএস হয় ২ টাকা ৬১ পয়সা। এর আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ২ টাকা ৪৪ পয়সা। এর মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৬ কোম্পানির ইপিএস হয় ৪৪ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩৩ পয়সা।
ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৬১ দশমিক ৬৮ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। বাকি ১৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
চলতি বছরের শুরুতে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। এছাড়া পরিবর্তন আসে ব্যাংকটির পর্ষদ সদস্য, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে।