Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 6:39 pm

লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম প্রতি দিন বাড়ছে। বর্তমান বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিটা যে হারে ঘটছে, তা অর্থনীতির কোনো নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বর্তমান বাজার দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিটা এতই বেড়েছে যে, দিনমজুর মানুষের প্রতিদিনের আয়ের সবটুকু খাদ্যপণ্য কিনতে শেষ হয়ে যায়। অথচ বিকল্প আয় বা কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ ঘটছে না। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি ঘটা একটা স্বাভাবিক চিত্র। কারণ অর্থ সমাগম বাড়লে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। বাংলাদেশে যে হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অভিঘাত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রতিটি ওষুধের দাম বাড়ছে। গত জুন মাসে যে ইউরোম্যাক্স ট্যাবলেট প্রতিটির দাম ছিল ৯ টাকা তা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকায়। এখানে বৃদ্ধির হার ২২ দশমিক ২২ শতাংশ। যে বুডিকট নাম একটি ওষুধের দাম ছিল প্রতিটি ৩৬ টাকা তার বর্তমান বাজার ৪৫ টাকা। এখানে বৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ। জুলাই মাসে যে লাউ ২৫ টাকা দিয়ে কেনা যেত তার বর্তমান বাজার ৫৫ টাকা (রাজশাহীর সাহেববাজারের হিসাবে)। এখানে বৃদ্ধির হার ১২০ শতাংশ। জুলাই মাসে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৪ টাকা কেজি, বর্তমানে সেই চালের দাঁড়িয়েছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি। এখানে বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। কাঁচামরিচ জুলাই মাসে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে।

কাঁচামরিচের বৃদ্ধির হার ৭০০ শতাংশ। প্রতিটি পণ্য ধরে ধরে হিসাব করলে দেখা যায় , সব ধরনের পণ্যের বৃদ্ধি ঘটেছে প্রায় ৩০ শতাংশের ওপরে। কোনো কোনো পণ্যের এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যার হার ৭০০ থেকে ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থনীতির নিয়মানুসারে বাজারে অর্থসমাগম বড়লে পণ্যের বৃদ্ধি পায়। অর্থ্যাৎ মানুষের আয় যদি বেড়ে যায় তাহলে তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে। ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে মূল্যস্ফীতি দেখা যায়। এখানে প্রশ্ন হলো গত জুলাই মাসে ব্যক্তির যা আয় ছিল তা কি বেড়েছে? সাদা চোখে এর উত্তর হবে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে একজন দিনমজুরের দৈনিক মুজরি ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় । বর্তমানে ওই মজুরিটা তো বাড়েনি বরং কমেছে। মজুরি কমার কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা এখন আর কৃষিকাজে শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারছেন না। কারণ নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওই শ্রমিকের কাজগুলো নিজেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তা নিয়ে করে ফেলছেন। কৃষকেরা নিজের সংসার চালাতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন। তাই দেখা যায়, কৃষি ক্ষেত্রের কিছু কাজ চুক্তিতে শ্রমিকদের দিচ্ছেন, দিন হিসাবে না দিয়ে। অপরদিকে হাতে কাজ না থাকায়, দিনমজুররা অনেকটা বাধ্য হয়ে কম মূল্যে চুক্তিতে কাজ করার জন্য রাজি হন কৃষকদের সঙ্গে। ফলে দেখা যায়, এই কাজটি সম্পাদন করার পর তার দৈনিক মুজরিটা জুলাই থেকে অনেকটা কমে গেছে। অন্যদিকে দেখা যায়, কোন সেক্টরের শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়েনি অর্থ্যাৎ মজুরি বৃদ্ধি পায়নি।

ক্রেতার হাতে প্রকৃতার্থে অর্থ সমাগম হয়নি তারপরও বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অর্থনীতির কোনো নিয়মে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তা বোধগম্য হচ্ছে না সাধারণ মানুষের। সম্প্রতি সময় টিভির একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় , মানিকগঞ্জের একজন কৃষক লাউ চাষ করছেন। ওই কৃষক তার উৎপাদিত লাউ উৎপাদন স্থলের বাজারে প্রতিটি বিক্রি করছেন ২৫ টাকায়। ওই লাউগুলো ট্রাকে করে রাজধানীর কাওরানবাজারে নিয়ে আসা হয়। সময় টিভির প্রতিবেদকের ধারা বর্ণনায় দেখা গেল, লাউয়ের ট্রাকটি ঢাকা আসার পথে কাউকে কোনো প্রকার চাঁদা দিতে হয়নি। চাঁদাবাজমুক্ত সড়ক হয়েছে হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই। কাওরান বাজারে এসে এই লাউয়ের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। প্রতিবেদনের বর্ণনানুুযায়ী দেখা গেল, ভ্যানে করে পাড়ায় পাড়ায় মানিগঞ্জের লাউ প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা করে। অর্থ্যাৎ ভোক্তা লাউটি কিনছেন ১০০ টাকায়। আর লাউটির দাম উৎপাদক পেয়েছে ২৫ টাকা। বৃদ্ধির এই ৭৫ টাকা গেল কই। ট্রাক ভাড়া এবং পাইকারের লাভ হিসাব করে ক্রয়মূল্যের সঙ্গে যোগ করলে কি ৭৫ টাকা হয়ে যায়। এই হিসাবটি কি সরকারের বাজার ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যন ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, জুলাইয়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ । আগস্ট মাসে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ সম্পর্কে বিবিএস যা বলছে, তা বাস্তবের সঙ্গে কতটা মিলে? বিবিএসের তথ্য এক ধরনের। তার সঙ্গে বাস্তবতার আদৌও মিলে না। তাই যথাযথ হিসাব করলে দেখা যাবে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের চেয়ে বাস্তবে অনেক বেশি।

বিবিএসের একটি তথ্য বলছে, এই সময়ে নাকি দক্ষ শ্রমিকের মজুরি ৭ দশমিক ৯৩ থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। এই হিসাবে মজুরি বাড়ল শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ যা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যাবে না। বিবিএসের প্রকাশিত তথ্য থেকে আরও জানা যায়, জুলাই মাসে খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে। তবে এটা প্রকৃত বিচারে কতটা সঠিক তাও প্রশ্ন বিদ্ধ। রাজস্ব রীতি অনুযায়ী বলা হয়, একটি দেশের সরকার সাধারণত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে জন্য বিদেশ থেকে ঋণ বা সহায়তা গ্রহণ করেন এবং গ্রহণ করা অর্থ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করে, তখন বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যায়, আর তখন ঘটে মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পণ্য মূল্যের ওপর পড়ার জন্য পণ্যের বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে দেশের অর্থ বাজারে তার প্রভাবও পড়েনি তারপরও দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকল্পগুলোর ফান্ড না আসায় প্রান্তিক ঠিকাদাররা অর্থ কষ্টে ভুগছেন।

বর্তমানে দেশের খাদ্যপণ্য বৃদ্ধির হারটা গাণিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে পণ্যর বৃদ্ধির কারণে বাজার ব্যবস্থা অনেকটা অরাজক হয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে না। দেশের কাঁচাবাজারে খাদ্যপণ্যের দাম চাওয়ার বিষয়টি বদলে গেছে। আগে বেগুন বিক্রেতাকে মূল্য জিজ্ঞেস করলে বলতেন, প্রতিকেজি ৩০ টাকা। এখন বাজারে বেগুন বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন আধা কেজি বেগুন ৬০ টাকা। এখানে দাম চাওয়ার একটি পরিমাণগত অবস্থার পরির্বতন হয়েছে। কারণ মানুষ আগের পরিমাণে জিনিস কিনছে না। কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে এখন বিক্রেতা দাম চান এভাবে ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ ৫০ টাকা। অথচ দুই মাস আগে দাম চাওয়া হতো আড়াইশ’ গ্রাম কাঁচামরিচ ২০ টাকা। খাদ্যমূল্যের এ ধরনের বৃদ্ধিতে নাভিঃশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। বর্তমানে মানুষের খাদ্য গ্রহণ অভ্যাসটাও পরিবর্তিত হচ্ছে। শাকসবজি ফলমুল, ডিম, দুধ, মাছ, মাংস এ ধরনের খাদ্য খাওয়ার বিষয়ে পরিমাণগত মাত্রাটা কমিয়ে দিয়েছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। রাজশাহীতে এ-ই প্রথম ইলিশ মাছ কেটে বিক্রি হতে দেখা গেছে। দেশের সর্বক্ষেত্রে একটি নীরব খাদ্যাভাব দেয়া দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন সংস্কারের দিকে নজর দিয়েছেন। তবে সরকারের উচিত দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া। বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি জরুরি দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা। তা না হলে মেল নিউট্রেশনের কবলে দেশের প্রায় শতকরা ৫০ শতাংশ মানুষ পতিত হবে।