লাগামহীন দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের নাভিশ্বাস

মেসবাহ উদ্দিন মিহির: সম্প্রীতি ও শান্তির বাণী নিয়ে বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। কিন্তু রমজানের আনন্দকে ম্লান করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে দেশের সাধারণ মানুষকে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন বাংলাদেশের জন্য নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বৃদ্ধি পেলে তা আর কমে না, কমলেও তা খুবই সামান্য। যেখানে পবিত্র রমজান মাসে অন্যান্য দেশে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে রমজান উপলক্ষে উল্টো লাগামহীন বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। রমজানকে উপলক্ষ্য করে অসাধু ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করার চেষ্টা করে এবং বেশি লাভের আশায় কিছু সিন্ডিকেট বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে থাকে। ফলে জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায় নিত্যপণ্য সামগ্রী।

গত কয়েকদিনে দেশে একে একে বেড়েছে প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রের দাম। কয়েক দফা বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমনÑতেল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদির মূল্য। সরকার কর্তৃক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও নির্ধারিত মূল্যে মিলছে না এসব পণ্য। কেননা সরকারিভাবে নির্ধারিত মূল্যকে ব্যবসায়ীরা গুরুত্ব দেয় না। ফলে রমজানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য যেমনÑভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মুড়ি, খেজুর, গুঁড়া দুধ, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা ইত্যাদির মূল্য যেন আকাশচুম্বী। বাজারে এখন ভোজ্যতেল-বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা প্রতি লিটার। চিনি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা কেজি। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় এবং গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১,২০০ টাকা কেজি। মাংসের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাছের দামও। বাজারে এখন প্রতি কেজি মাছ ২০০ টাকার কমে পাওয়া দুষ্কর। সাধারণত রমজানে দুগ্ধজাত বিভিন্ন খাবার তৈরি হওয়ায় দুধের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের মূল্য বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৭৮০ থেকে ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের বাজারদরের ওপর টিসিবির করা প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের দাম ১০ থেকে ১১৬ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কভিড মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট সংকটের দোহাই দিয়ে দেশে ক্রমান্বয়ে প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করা হলেও তার বিপরীতে  সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি সাধারণ মানুষের দৈনিক আয়। দ্রব্যমূল্যের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বাজার করতে গেলে ঘাম ছুটে যাচ্ছে নি¤œ আয়ের মানুষদের। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে তাদের কপালে পড়ছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দেখা যাচ্ছে, যেকোনো জিনিসের সকালে এক দাম তো বিকালে আরেক দাম; যা ক্রমেই ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে জনসাধারণের মনে। ধীরে ধীরে সবকিছু যেন ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারগুলোর। সবমিলিয়ে যেন দেশে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা বিরাজমান। এমন পরিস্থিতিতে রমজানে ঠিকমতো খাদ্য ক্রয় করতে পারছে না নি¤œ আয়ের মানুষজন। অনেকে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চরম হতাশা বিরাজ করেছে তাদের মধ্যে। এসব শ্রেণির মানুষের কথা চিন্তা না করে রমজানে আকস্মিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করাটা কতটুকু যৌক্তিক? দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা না হলে কিংবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে খাদ্যাভাব ও ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য না পাওয়ায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এতে রাষ্ট্রের প্রতি জনসাধারণের দায়বদ্ধতা বা শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি ক্ষুণœ হবে। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য তৈরি না হলে দেশের নি¤œ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি খাবার জোগাড় করতে অপারগ হয়ে পড়বে। ফলে পুষ্টিকর খাদ্যাভাবে একটি পুষ্টিহীন সমাজ গড়ে উঠবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধি যেকোনো দেশেরই স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিনষ্ট করে। তাই কোনো জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথাযথ পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ ও জনসাধারণকে আগে থেকেই অবহিত করা উচিত। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কর্তৃপক্ষের উচিত যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। রমজানে দেশের চাহিদা অনুযায়ী সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানির ব্যবস্থা করা। টিসিবির কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে টিসিবি পণ্য আরও সহজলভ্য করে দেয়া, যাতে অসচ্ছল শ্রেণির মানুষও রমজানে ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সরকার কর্তৃক রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় পণের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং নিত্যপণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য তদারকি ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিহত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অসাধু বিক্রেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখা জরুরি। দেশের নি¤œ-মধ্য আয়ের মানুষের অবস্থা বিবেচনা করে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ক্রেতার অনুকূলে রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়