শেয়ার অধিগ্রহণ ও ব্যাংকঋণে অসংগতি

লাভেলোর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বিএসইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটেগরির কোম্পানি তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। অতিরিক্ত শেয়ার অধিগ্রহণ ও ব্যাংকঋণের বিপরীতে বড় অঙ্কের জামানত-সংক্রান্ত তথ্য ঘিরে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গঠন করেছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।

কমিটির সদস্যরা হলেনÑবিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আল মাসুম মৃধা, সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম ও নাভিদ হাসান খান। তদন্ত কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বিএসইসির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটিকে বেশ কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে তৌফিকা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কীভাবে ১ কোটি ১৫ লাখ অতিরিক্ত সাধারণ শেয়ার অধিগ্রহণ করেছে; এই অধিগ্রহণের প্রস্তাব কাদের মাধ্যমে ও কীভাবে অনুমোদিত হয়েছিল এবং আইএএস ২৪ অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদনগুলোয় সংশ্লিষ্ট লেনদেন যথাযথভাবে প্রকাশ পেয়েছে কি না।

এছাড়া ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সীমান্ত ব্যাংক থেকে পাঠানো একটি চিঠির ভিত্তিতে জানা যায়, কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. একরামুল হকের নামে থাকা ৫০ লাখ শেয়ার ব্যাংকঋণের জামানত হিসেবে রাখা হয়েছে। বিএসইসি মনে করছে, এর পেছনে রয়েছে অনিয়ম বা শেয়ারহোল্ডারদের অন্ধকারে রেখে নেয়া সিদ্ধান্ত, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি হতে পারে।

এই ঋণ চুক্তি এবং জামানতের শর্তাবলি কতটা স্বচ্ছভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা পুঁজিবাজার আইন অনুযায়ী বৈধ কি না, সেটিও খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি। প্রাথমিকভাবে কমিশন মনে করছে, এই ধরনের কার্যক্রম পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যদি এগুলোর পেছনে অনিয়ম থাকে। তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯-এর সেকশন ২১-এর আওতায়। একইসঙ্গে জামানত ইস্যুর ক্ষেত্রে ধারা ২০ প্রযোজ্য ধরা হয়েছে।

তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি সর্বশেষ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মোট ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, এর মধ্যে ১০ শতাংশ নগদ এবং ১০ শতাংশ বোনাস। ওই সময় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ১ দশমিক ৪৩ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে (১ দশমিক ২৪ টাকা)। একই বছর শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৩৭ টাকা।

২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এই কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যার বিপরীতে মোট শেয়ারসংখ্যা ৯ কোটি ৩৫ লাখ। ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে রয়েছে ৪০ দশমিক ০৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২১ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৩৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ শেয়ার। সর্বশেষ ৪ মে (রোববার) কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮৩ দশমিক ৪ টাকা দরে, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অস্বাভাবিক ওঠানামাও লক্ষ করা গেছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের ওপর এমন অস্বচ্ছ লেনদেন ও ঋণ জামানতের ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে। তদন্তে যদি অনিয়ম ধরা পড়ে, তাহলে কোম্পানির শেয়ারদর ও বাজার ইমেজ, দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসির এই পদক্ষেপকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে তদন্ত নিরপেক্ষ না হলে তা বিপরীত প্রতিক্রিয়াও তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা।

লাভেলোর শেয়ার ও ঋণ লেনদেনের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে জটিল এবং সুনির্দিষ্ট তদন্ত ছাড়া এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিএসইসির তৎপরতা বিনিয়োগকারীদের জন্য আশার আলো হতে পারে, যদি তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়।