লালমনিরহাটের বিড়ি শ্রমিকরা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায়

ফারুক আলম, লালমনিরহাট: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আর বিড়ি শ্রমিক যেন সমার্থক। তারা যুগ যুগ ধরে সামান্য মজুরিতে কাজ করছেন। একই সঙ্গে তারা উপেক্ষা করেছেন নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ। এ ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রেরণাদায়ক বক্তব্যই দায়ী, সঙ্গে রয়েছে সামাজিক সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। এ চতুর আগ্রাসন গড়ে উঠেছে তুলনামূলক অসচ্ছল এলাকাগুলোয়।

মঙ্গা নামক ভৌতিক শব্দের ব্যবহার উঠে গেছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে রয়ে গেছে মঙ্গা নামক শব্দের শেকড়। এর ওপর ভর করে এখনও বিড়ি কোম্পানিগুলো তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গোল্ডেন, বেঙ্গল, আবুল, মনসুর ও মতি বিড়ির ফ্যাক্টরি এ জেলায়।

এসব কারখানায় কাজ করছেন কয়েক স্তরের বিড়ি শ্রমিক। প্রথম দুই স্তরে বেছে নেয়া হয়েছে নিম্নমানের মজুরি। এ দুই স্তরে কাজ করে শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষ। স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে এ স্তরে।

বিড়ি শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১০ হাজার বিড়ি সম্পূর্ণ তৈরি করে দিয়ে মেলে মাত্র ৪১০ টাকা। তাদের মধ্যে বিড়ির কাগজ রোলকারীদের এক হাজার রোলের জন্য ১৪ টাকা বরাদ্দ। ২৫টি বিড়িতে এক প্যাকেট। এক প্যাকেট বিড়ি তৈরিতে শ্রমিক মূল্য মাত্র এক টাকা। হাত ঘুরে এক প্যাকেট বিড়ির বাজার মূল্য ১৫ টাকা।

বিড়ি শ্রমিকরা বলেন, ভোর ৪টা থেকে কাজ শুরু হয়। বিকাল ৪টায় শেষ হয়। এ কাজ করে পোষায় না।

স্থানীয় সমাজসেবক রেজাউল করিম বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের কাজে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি অনেক বেশি, বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্য। তাদের শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমি চাই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করা হোক। সরকারি বিধিনিষেধ মেনে সপ্তাহজুড়ে কাজ পাক শ্রমিকরা।

সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক মাহফুজুর রহমানের মতে, বিড়ি শ্রমিকদের তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করা হচ্ছে না। আইএলও স্ট্যান্ডার্ড মানা হচ্ছে না। সাধারণভাবে বললে, এখানে ন্যূনতম মজুরি মানা হচ্ছে না। একজন কর্মহীন বেকার মানুষের শ্রম নিয়ে, তার শ্রমের মূল্য কম দেয়ার সুযোগ নেই। কর্মহীন বেকার মানুষের শ্রম নিলে, তাকেও শ্রমের বাজার মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

প্রাণিবিদ নারায়ণ চন্দ্র বলেন, কাঁচা তামাক পাতার আঠালো নিকোটিন প্রাণীর ত্বকে লেগে লোম ও ত্বকের ক্ষতি করে।

তিনি আরও বলেন, ধূমপান মানবদেহের বেশিরভাগ অঙ্গের ক্ষতি করে। তামাক মূলত হƒৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুস আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজসহ নানা ধরনের ক্যানসার হতে পারে।

গর্ভবতী নারীদের ওপর তামাকের ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। ধূমপায়ী নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ঘটার হার বেশি।

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম (থোরাসিক সার্জন, জাতীয় বক্ষব্যাথি ইনস্টিটিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান) বলেন, বিড়ি শিল্প গড়ে উঠেছে তামাকের ওপর নির্ভর করে। বিড়ি ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করবেন, তাদের ফুসফুসের নানা রোগের পাশাপাশি ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ঝুঁকি বেড়ে যাবে শিশু ও নারী এ খাতে কাজ করলে। যক্ষ্মার একটি অন্যতম কারণ বিড়ি বা তামাক।

আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরির ম্যানেজার আবু তাহের বলেন, ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় কি নাÑআমার এখানে খোঁজ নিবেন কেন? যে পত্রিকায় কাজ করেন, সেই পত্রিকাতে খোঁজ নেন। আমরা বিধি মেনে চলি কি না, তা সরকার দেখবে।’

আকিজের রিজিওনাল ম্যানেজার দাবি করা এক ব্যক্তি বলেন, আমরা লেখাপড়া করে এসেছি। আমরা সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য বুঝি। এসব করবেন না।

আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরির ম্যানেজার বলেন, আমি ঢাকায় রোগী দেখতে এসেছি। পরে কথা বলব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২০০৬ সালের শ্রম আইন তুলে ধরেন। তাতে বলা আছে- ৯]২) সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোনো কিশোরকে নিয়োগ দেয়া যাইবে না।

৩৪]১) কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাইবে না বা কাজ করিতে দেয়া যাইবে না।