Print Date & Time : 8 July 2025 Tuesday 5:38 pm

লিচুচাষে সম্ভাবনা থাকলেও কৃষক পান না প্রাপ্য মূল্য

গ্রীষ্মের সেরা ফলগুলোর একটি লিচু- স্বাদ, গন্ধ আর রসালতার জন্য দীর্ঘকাল ধরে দেশের নানা অঞ্চলে এর কদর। তবে লিচু শুধু একটি মৌসুমি ফল নয়, এটি একটি আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রাণও। বিশেষত রাজশাহী, দিনাজপুর, মাদারীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও টাঙ্গাইল- এই অঞ্চলে হাজার হাজার কৃষক লিচু চাষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা, অপরিকল্পিত বাজারজাতকরণ এবং সরকারিভাবে কৃষকের সুরক্ষায় কাক্সিক্ষত পদক্ষেপের অভাবে এই শিল্পটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

লিচু চাষে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। লিচুর মুকুল ও গুটি ধরার সময় যদি অনুকূল আবহাওয়া না থাকে- যেমন হালকা ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহ- তাহলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাজশাহীর মাঠে গুটি এলেও সময়ের আগেই তীব্র গরম ও ঝোড়ো হাওয়ায় ফল নষ্ট হয়েছে অনেকাংশে। ফলন কমেছে, অথচ বাজারে চাহিদা বেশি- ফলে দাম আকাশছোঁয়া, কিন্তু মান ও স্বাদে তেমন পরিপক্বতা নেই। এতে একদিকে যেমন ভোক্তা ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে কৃষকও নিরুপায়। কোথাও আগাম খরার ঝুঁকি, কোথাও মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে শিলাবৃষ্টির আঘাত, আবার কোথাও পরিবহন সংকটে লিচু নষ্ট হচ্ছে ট্রাকেই। ফলে এই খাতে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।

সংকটের গভীরে রয়েছে আরেকটি সমস্যা- লিচুর অপরিপক্ব আগাম বাজারজাতকরণ। অনেক কৃষক বাধ্য হচ্ছেন সময়ের আগেই ফল সংগ্রহে, কারণ বাজার ধরার তাড়া এবং ঋণ পরিশোধের চাপ। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর পরিণামে বাজারে যাচ্ছে স্বাদহীন ও ছোট লিচু। এতে দীর্ঘমেয়াদে ঐতিহ্যবাহী লিচুর সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার তো বটেই, ভবিষ্যতে রপ্তানির সম্ভাবনাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অথচ এই সংকটের মধ্যেও সম্ভাবনার দ্বার খোলা রয়েছে। বাংলাদেশের লিচুর জাত, স্বাদ ও মৌসুমি বৈচিত্র্য দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে সহজেই প্রতিযোগিতা করতে পারে। দরকার শুধু একটি সমন্বিত কৃষি পরিকল্পনা। গবেষণাভিত্তিক জলবায়ুসহিষ্ণু লিচুর জাত উদ্ভাবন, আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী চাষ পদ্ধতির মানোন্নয়ন, হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং কৃষকদের সরাসরি বিক্রির প্ল্যাটফর্ম তৈরি এখন সময়ের দাবি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, লিচুচাষিরা যেন তাদের ফলের ন্যায্য দাম পান। দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে আজ কৃষক লাভ থেকে বঞ্চিত হন, অথচ ভোক্তা চড়া দামে কিনতে বাধ্য হন। এই ব্যবধান কমাতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর বাজার ব্যবস্থা ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য দর নির্ধারণের মাধ্যমে। লিচু আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর সম্ভাবনা এবং সমস্যা উভয়ই বাস্তব। এখন প্রয়োজন আন্তরিক, পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, যাতে কৃষক বাঁচে, বাজারে স্বস্তি আসে এবং লিচুর ঐতিহ্য রক্ষা পায়।