Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 10:05 pm

লোকসানে চাপা পড়েছে ৫ বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানি

গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য। এরপরও বিদ্যুৎ খাত বিশেষত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বেড়ে চলেছে। ফলে বেড়েছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি। এরপরও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের চিত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: চাহিদা বিবেচনায় না করেই গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়মিতই বসে থাকছে। আবার জ্বালানি সংকটেও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই গুনতে হচ্ছে। এছাড়া জ্বালানির উচ্চ ব্যয় ও ডলারের বিনিময় হার বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এতে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বেচে লোকসানে পড়েছে বিতরণকারী চার কোম্পানি ও এক সংস্থা।

বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চারটি কোম্পানিই লোকসান দিয়েছে। যদিও এর তিনটিই ২০২১-২২ অর্থবছর মুনাফায় ছিল। অপর কোম্পানিটি আগের অর্থবছর সামান্য লোকসান করলেও গত অর্থবছর তা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দেশের ৮০ শতাংশ গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ সংস্থাটি ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসানে ছিল। তবে গত অর্থবছর তার লোকসান ৩৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সূত্রমতে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ছে ১১ টাকার ওপরে। তবে গত অর্থবছর শুরুতে এর বিক্রয় মূল্য ছিল পাইকারীতে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা। পরে তা দুই দফা দাম বৃদ্ধি করা হয়। এতে ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার দাঁড়ায় ছয় টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে গত অর্থবছর বিতরণ পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যহার বাড়ানো হয় ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাল্কের তুলনায় খুচরায় বিদ্যুতের দাম কম বাড়ানোয় লোকসানে পড়ে বিতরণকারী সংস্থা ও কোম্পানিগুলো।

তথ্যমতে, ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুই কোম্পানি ২০২১-২২ অর্থবছর মুনাফায় ছিল। ঢাকার দক্ষিণাংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসি ওই বছর মুনাফা করে ১৬৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছর কোম্পানিটি রেকর্ড ৬৬১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা লোকসান করেছে, যা ডিপিডিসির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

অন্যদিকে ঢাকার উত্তরাংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব থাকা ডেসকো ২০২১-২২ অর্থবছর মুনাফা করেছিল ৬৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। তবে  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবারই প্রথম লোকসানে পড়ল ডেসকো।

জানতে চাইলে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছর বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বাড়ানো হয়েছে ২৯ শতাংশের বেশি। কিন্তু খুচরায় বাড়ানো হয়েছে ১৫ শতাংশের মতো। দামের এই পার্থক্য ডেসকোকে লোকসানে নিয়ে গেছে। তবে লোকসানের সিংহভাগই হয়েছে টাকার অবমূল্যায়নে।

তিনি বলেন, ‘বিদেশি সংস্থাগুলো থেকে যেসব ঋণ নেয়া হয়েছে সেগুলো ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধের খরচও বেড়ে গেছে। আমরা টাকায় আয় করি আর ডলারে ঋণ পরিশোধ করি। এখানেও একটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। আর যখন ঋণ নেয়া হয়েছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা। এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে এক ডলার সমান ১০৯ থেকে ১১০ টাকায়। কেবল ডলারের বাড়তি দরের জন্য বাড়তি ৪২৮ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।’

সূত্রমতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ২০২১-২২ অর্থবছর সামান্য লোকসান করেছিল। ওই অর্থবছর কোম্পানিটির লোকসান ছিল আট কোটি ১৯ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছর তাদের লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৩ কোটি তিন লাখ টাকা। আর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দান ইলেকট্রিসিটি কোম্পানি (নেসকো) ২০২১-২২ অর্থবছর মুনাফা করেছিল ৩১ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছর কোম্পানিটি লোকসান করেছে ৮৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এদিকে চার বিতরণকারী কোম্পানির বাইরে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) নিজেই। তবে দেশের বৃহৎ অঞ্চলেই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে আরইবি। ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করে এ সংস্থাটি। আরইবি ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান গুনেছিল ৫২৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে গত অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ তথা গ্রাহক পর্যায়ে কোনো ভর্তুকি দেয়া হয়। তবে উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি পায় পিডিবি। গত অর্থবছর রেকর্ড ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করা হয়েছে পিডিবির জন্য। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কারণ গত অর্থবছর পিডিবি রেকর্ড ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। তাই লোকসানের ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিকল্প নেই। যদিও এখনই বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না সরকার।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লোকসান কমাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে এ ধরনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, গত ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়ার বিষয়ে জানতে চায় আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এ সময় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দিতে পর্যায়ক্রমে দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হতে পারে।