লোকসানে ডুবলেও শেয়ারদর বাড়ছে জুট স্পিনার্সের

পলাশ শরিফ: পাটখাতের পিছিয়ে পড়া কোম্পানি জুট স্পিনার্স। চার বছরে কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান প্রায় ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ আর্থিক বছরেও প্রায় ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা লোকসান গুণেছে কোম্পানিটি। লোকসানের কারণে প্রায় ১৩ মাস ধরে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তার পরও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে স্বল্পমূলধনি কোম্পানিটির শেয়ারদর। গত তিন মাসে জুট স্পিনার্সের দর প্রায় ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ কোম্পানিকে তিন মাসে দু’দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েও শেয়ারদরে লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে ডিএসই।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চের শুরুতে জুট স্পিনার্সের প্রতিটি শেয়ার ৫৪ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিলো, যা গতকাল সোমবার সর্বশেষ ৯৬ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছে। সেই হিসেবে গত তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৭৭ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ বেড়েছে। যা টাকার অঙ্কে দাঁড়িয়েছে ৪২ টাকা। এর মধ্য দিয়ে গত দুই বছরে প্রায় ৫৪ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে কোম্পানিটির শেয়ারদর। এমতাবস্থায় কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মনে করছে ডিএসই।

জুট স্পিনার্সের কোম্পানি সচিব এটিএম মুস্তাফা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রতিকূল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পণ্যের রপ্তানি মূল্য হ্রাস, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও ভর্তুকি কমে যাওয়াসহ বেশকিছু কারণে চার বছর ধরে লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। টানা লোকসানের মুখে মূলধন সঙ্কটের কারণে প্রায় দেড় বছর উৎপাদন বন্ধ। তাই অফিসে তেমন কেউ আসে না। অফিসের কার্যক্রমও বন্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জকে আমরা তা জানিয়েছি। এ অবস্থায় কেন দর বাড়ছেÑসেটাও আমরা জানি না। সেটা আমরা বিএসইসি-ডিএসইকে জানিয়েছি।’

তবে নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি, উৎপাদন আবার চালু ও ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা হচ্ছে কি নাÑএ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি কোম্পানিটির দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা।

এদিকে লোকসানি ও স্বল্প মূলধনি ওই কোম্পানির শেয়ারদরে ‘অস্বাভাবিক’ বৃদ্ধি ঠেকাতে গত তিন মাসে দু’দফায় নোটিশ পাঠিয়েছে ডিএসই। চলতি বছরের ১৭ মে প্রথম দফায় দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিলো ডিএসই। প্রায় ১৫ দিন শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী থাকার কারণে ওই নোটিশ পাঠানো হয়। ওই সময়ে প্রায় ১৬ টাকা দর বেড়েছিলো। এর জের ধরে প্রায় এক মাস থমকে ছিল জুট স্পিনার্সের দর। এরপর আবারও বাড়তে শুরু করে। ২২ জুলাই থেকে আবারও দর বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ৩২ টাকা বেড়ে সর্বশেষ ৯৯ টাকা ছাড়িয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেই ১৮ জুলাই দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছে ডিএসই। আর দুই নোটিশের জবাবেই ‘সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই’ বলে জানিয়েছে জুট স্পিনার্স। তবে তার পরও দর বাড়ার প্রবণতা বন্ধ হয়নি। বরং ডিএসই নোটিশের পরও টানা শেয়ারদর বাড়ছে।

তবে স্বল্পমূলধনি এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ‘কারসাজি’ হয়। সে কারণেই শেয়ারদর ‘অস্বাভাবিক’ বাড়ে বলে দাবি করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আলাপকালে বিনিয়োগকারী মিজান উর রশিদ চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জুট স্পিনার্স নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। সব সময়েই অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার বাড়ে। ডিএসই নোটিশ দেয়, আর কোম্পানিমূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই বলে জানায়। বিতর্ক হলে কিছুদিন কারসাজি থেমে থাকে। কিছুদিন পর আবারও দর বাড়তে থাকে। বিনিয়োগকারীরা না বুঝে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়।’

কোম্পানির দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্যমতে, বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণে লোকসানে পড়ে জুট স্পিনার্স। চার বছর টানা লোকসানের কারণে মূলধন সঙ্কটে পড়ে কোম্পানিটি। এর জের ধরে ২০১৬ সালের ১ জুলাই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) বিনিয়োগকারীদের দাবির মুখে স্বল্পসময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এজন্য পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি, অর্থের সংস্থানে ব্যাংক ঋণসহ বেশকিছু তথ্যও তুলে ধরেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উজ জোহা। তবে নয় মাসেও এসব প্রতিশ্রুতি পূর্ণ রূপ পায়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জুট স্পিনার্সের উৎপাদন শুরু হয়নি। কবে নাগাদ উৎপাদন চালু হবে- সে বিষয়েও তথ্য মেলেনি।

তথ্যমতে, ২০১৩ সাল থেকে লোকসান গুনছে পাটখাতের কোম্পানি জুট স্পিনার্স। ওই বছরে প্রায় আট কোটি ১৮ লাখ টাকা কর-পরবর্তী লোকসান গুনেছে কোম্পানিটি। একইভাবে সর্বশেষ আর্থিক বছরেও প্রায় সাত কোটি ১৫ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে কোম্পানিটি। গত চার বছরে কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। লোকসানের কারণে চার বছর ধরে কোনো প্রকার লভ্যাংশ দিচ্ছে না জুট স্পিনার্স। তাই ভোগান্তির ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে কোম্পানিটি। উৎপাদন ও কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ২০১৬ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের পর আর কোনো নিরীক্ষিত-অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি।

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় শামস গ্রুপের কোম্পানি জুট স্পিনার্স। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন এক কোটি ৭০ লাখ টাকা। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিটির বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ১৭ লাখ। এর মধ্যে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৩ দশমিক ২০ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৩৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ২০১২ সালে বিনিয়োগকারীদের সর্বশেষ ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে জুট স্পিনার্স।