শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

মো. জিল্লুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো পর্যায়ে শিক্ষা নেয়া-দেয়ার সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের কাছে  এ বিশ্ববিদ্যাল অহংকার, ভালোবাসার আবেগ, স্মৃতির মিনার, জ্ঞানের পাদপ্রদীপ, সর্বোপরি আকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ঢাবির যেকোনো অর্জন, খ্যাতি ও সুনাম যেমন তাদের হƒদয়কে নাড়া দেয়, প্রাণকে আন্দোলিত করে, মনকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে, ঠিক একইভাবে এর যেকোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমালোচনা কিংবা অবমূল্যায়ন মনকে ব্যথিত করে এবং পীড়া দেয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র, শিক্ষক বা গবেষক যখন বিদেশের কোনো নামিদামি বিশ্বিবদ্যালয় কিংবা গবেষণাগারে সুনাম-সুখ্যাতির জ্যোতি ছড়ায়, সেটা যেমন বিশাল গর্বের ও অনুপ্রেরণার,  ঠিক একইভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ যখন কোনো নেতিবাচক কাজে জড়িত হয় এবং সেটা প্রচারিত হয়, সেটা ঠিক একইভাবে বেশ লজ্জার ও মর্মবেদনার কারণ।

ঢাবি ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে হিসেবে ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০২১ সালের ৩০ জুন ১০০ বছর পূর্ণ করেছে। ঢাবি প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাবি শতবর্ষ পালন করছে, কাকতালীয় এ ঘটনা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শতবর্ষের এ ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে ঢাবির ছাত্র হতে পেরে সত্যিই গর্বিত ও পুলকিত অনুভব করছি। একইসঙ্গে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হকদের মতো ঢাবি প্রতিষ্ঠাকালীন সাহসী প্রাণপুরুষদের, যাদের অবদান, ত্যাগ-তিতিক্ষা, মেধা ও শ্রমকে জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে ও করছে।

ঢাবি স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেটা শতভাগ অর্জিত হয়েছে। নেটিজনেরা এজন্য একে ’প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলেও সম্বোধন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ১৯২১ সালের ১ জুলাই শুরু করে ৯৯ বছর শেষ করে শতকের ঘর পূর্ণ করছে প্রাণের ঢাবি। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো অর্জন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই গৌরব ও আনন্দের।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাবি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে নিজের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটি তার কাক্সিক্ষত অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ঢাবি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে এবং এটা আমাদের জন্য অবশ্যই স্বস্তিদায়ক খবর নয়। দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গবেষক ও রাজনীতিবিদের জš§ হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে প্রাণের এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।

ঢাবির ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র-আন্দোলনের আছে সোনালি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ছয় দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক বিজয়ে ঢাবির ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র-আন্দোলন সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে। ছাত্ররাই ইতিবাচক আন্দোলনের সূচনা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রয়েছে ঢাবির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যেমন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, তেমনি ভোট পেতে, ছাত্রদের সমর্থন পেতেও ছাত্র সংগঠনগুলোকে ইতিবাচক কাজ করতে হয়। ছাত্রদের নানা সমস্যা এবং শিক্ষা বিষয়ে কথা বলতে হয় তাদের। আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু ছাত্র সংসদ  নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্রনেতাদের এখন আর সেই ভাবনা নেই। তৈরি হচ্ছে না গুণগত নেতৃত্ব। কিন্তু তারা দখলদারি রজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। হল দখল ও সিট দখল থেকে শুরু করে মার্কেট দখলেরও অভিযোগ পওয়া যায়, যা ঢাবির ছাত্ররাজনীতির জন্য কোনোক্রমেই সুখকর নয়। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছে ১৯৯০ সালের ৯ জুন। মজার ব্যাপার হলো, তখন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ক্ষমতায় ছিল। স্বৈরাচারের সময় ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও এরপর নির্বাচিত কোনো সরকারের অধীনেই ডাকসু নির্বাচন হয়নি। বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। অবশ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাবিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ সালে ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয়। কিন্তু তা নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা। এর মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, কিন্তু নতুন ডাকসু নির্বাচনের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

আসলে স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতি অর্থ, অস্ত্র আর পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার শুরু করে। ফলে ছাত্ররাজনীতি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও তাদের ব্যবহার করছে। ঢাবির ছাত্ররাজনীতি এ কারণে বোদ্ধা মহলে বেশ বিতর্কিত এবং রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ডের কারণে আগের মতো আর কোনো গ্ল্যামার ও আগ্রহ সৃষ্টি করছে না। ডাকসুকে বলা হয় সারাদেশে ছাত্ররাজনীতির আদর্শ নমুনা। সারাদেশে এর যে কদর, সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল, সেটা এখন আর চোখে পড়ছে না।

ঢাবির শিক্ষক রাজনীতিও এখন সরকারের তোষামোদ নীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের একটি মোক্ষম হাতিয়ার। নিজেদের দল বা মতকে ভারী করার জন্য অযোগ্য লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বলে প্রায়ই শোনা যায়। শিক্ষকরা যদি জানতেন যে তাদের মৌলিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা না থাকলে নিয়োগ ও পদোন্নতি তো মিলবেই না, চাকরিও থাকবে না। রাজনৈতিক পরিচয় বা ভিসির সঙ্গে সুসম্পর্ক পদোন্নতির কোনো মানদণ্ড হতে পারে না। অনেকে মনে করেন, গবেষণার জন্য তহবিল সংকট বড় কোনো সমস্যা নয়। যারা চাইছেন তারা বিদেশ থেকে তহবিল নিয়েও গবেষণা করছেন। অনেকে নীরবে-নিভৃতে ঠিকই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশ-বিদেশে তাদের সুনাম-সুখ্যাতি ঠিকই ছড়িয়ে পড়ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দকৃত গবেষণার অর্থও ফেরত যাওয়ার নজির রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা ধরনের বাণিজ্যিক কাজে জড়িয়ে যাওয়ায় গবেষণা দূরের কথা, পাঠদানের প্রস্তুতিও নিতে পারেন না ঢাবির অনেক শিক্ষক। এ অবস্থার মধ্যেও গবেষণার নামে যা হচ্ছে, তাতে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ঢাবির মতো প্রতিষ্ঠানে ’প্লেজিয়ারিজম’ বা (গবেষণা) চুরির ঘটনা ধরা পড়েছে, যা খুবই লজ্জাজনক ও অনভিপ্রেত।

ঢাবি শুরুতে স্বায়ত্তশাসিত মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবারিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হয়ে উঠেছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিবর্তন হয়ে যায়। নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জন্য গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা এবং ক্রমহ্রাসমান মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর উম্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই কেবল ঢাবি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার উপযোগী করে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। তবে ঢাবি ১০০ বছরেও একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি, এটাই এর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মৌলিক গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা, হলগুলোর ক্যান্টিনে ভালো মানের খাবার পরিবেশন, শিক্ষার্থীদের গণরুমের বিকল্প আবাসিক সুবিধার মতো নানা ধরনের সমস্যা সমাধান না করে ১০ টাকার শিঙাড়া-সমুচা নিয়ে গর্ব করা সত্যিই হাস্যকর বিষয়!

ঢাবি যে চিন্তা, চেতনা ও মান নিয়ে পদযাত্রা শুরু করেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সেটা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। যে ঢাবি একসময় সারাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল, ইদানীং সেটার মধ্যে একটি ব্যবসায়িক চেতনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে যে মৌলিক গবেষণার কথা বলা হয়েছিল, সেটা তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এই করোনা মহামারির সময় কিট ও জিনম সিকোয়েন্স নিয়ে সারাদেশে মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, কিন্তু প্রাণের ঢাবি সে প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমাদের আশা থাকবে, ঢাবির শিক্ষার্থীরা যাতে এই বিষয়টি অনুভব করে এবং বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে যে শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত, সেটা বাস্তবায়নে চলমান আন্দোলনে অংশ নেবে এবং প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে যে গর্বের জায়গা ছিল, সেটা আমরা ফেরত নিয়ে আসতে পারব।

ঢাবিতে গবেষণার জায়গা আরও বিস্তৃতি করা দরকার এবং একই সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চায় দেশের যে প্রতিনিধিত্ব করে, সেটা উত্তরোত্তর আরও বৃদ্ধি পাবে, আমরা সেটা প্রত্যাশা করি। গবেষণার জায়গায় আমাদের বিশ্বমানের দিক থেকে আরও দায়িত্ববোধ থাকা দরকার আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর, যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করে ঢাবি আরও বেশি সুনাম অর্জন করতে পারে।

শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উম্মেষ ও বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে আমাদের অস্তিত্বপ্রতিম এই প্রতিষ্ঠান শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপন করছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও একই বছর উদ্যাপিত হচ্ছে। তাই বছরটি হচ্ছে আমাদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা, সম্মান, আবেগ ও অনুভূতির সংশ্লেষে গৌরবদীপ্ত ও স্মৃতি-ভাবুকতার বছর।

ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক

সাবেক শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

zrbbbp@gmail.com