শবেকদর আরবিতে লাইলাতুল কদর। এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এছাড়া এর অন্য অর্থ হলো ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। এ রাতে ইসলামি অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্র্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত। কোরআনের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাতকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটিমাত্র রজনীর ইবাদতের ক্ষেত্রে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
শবেকদরের ইতিহাস: ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে শবেকদরের রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে সর্বপ্রথম কোরআন নাজিল হয়। মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাত সম্পর্কে হাদিস শরিফে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। এমনকি আল কোরআনে সুরা কদর নামে স্বতন্ত্র একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। এই সুরায় শবেকদরের রাতকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম ধর্মমতে, মোহাম্মদের পূর্ববর্তী নবী এবং তাদের উম্মতরা দীর্ঘায়ু লাভ করার কারণে বহু বছর আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু হজরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে তার পরবর্তী অনুসারীদের আয়ু অনেক কম হওয়ায় তাদের পক্ষে স্রষ্টার আরাধনা করে পূর্ববর্তীদের সমকক্ষ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয় বলে তাদের মাঝে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়। তাদের এই আক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের চিন্তা দূর করার জন্য সুরা কদর নাজিল করা হয় বলে হাদিসের বর্ণনায় জানা যায়।
ধর্মীয় গুরুত্ব: মুসলমানদের কাছে শবেকদর এমন মহিমান্বিত, বরকতময় ও বৈশিষ্ট্যম-িত এজন্য যে, এ রজনীতে মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ ‘আল কোরআন’ অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্পর্কে তুমি কী জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তি বিরাজ করে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত। (সুরা আল কদর, আয়াত ১-৫)
কদরের রাতের অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) এক মোবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সুরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)
ইসলাম ধর্মমতে, শবেকদরের রাতে ফেরেশতা ও তাদের নেতা জিবরাইল (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করে উপাসনারত সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবেকদরে হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকেন, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাজহারি)
গুরুত্ব: মুসলমানদের কাছে কদরের রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনের সুরা কদরে উল্লেখ আছে, হাজার মাস ইবাদতে যে সওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদত তার চেয়ে উত্তম। লাইলাতুল কদরের রাতে সৎ এবং ধার্মিক মুসলমানদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়। লাইলাতুল কদরে মুসলিমরা আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করে। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তার পূর্বেকৃত সব গুনাহ খাতা মাফ করে দেবেন। (বুখারি)
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, লাইলাতুল কদরের রজনীতে যে বা যারা আল্লাহর আরাধনায় মুহ্যমান থাকবে, স্রষ্টা তার ওপর থেকে দোজখের আগুন হারাম করে দেবেন।
সময়: হাদিস অনুযায়ী, ২০ রমজানের পর যে কোনো বিজোড় রাতে কদর হতে পারে। তবে ২৬ রমজান দিবাগত রাতেই লাইলাতুল কদর আসে বলে আলেমদের অভিমত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত মোহাম্মদ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবেকদর সন্ধান করো। (বুখারি ও মুসলিম)। আরেকটি হাদিসে মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোয় তোমরা শবেকদর সন্ধান করো।
-মুহাম্মদ আকিল নবী