মো. জিল্লুর রহমান: ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি মূলত শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এ দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে; যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
আসলে শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই শিক্ষক বলা হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিতদেরই শিক্ষক বলা হয়। যদিও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকতার কাজে যারা আছেন তাদের শিক্ষক বলা এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অধ্যাপক বলা হয়ে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরে যারা এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক মহান ব্রতের সাথে জড়িত তাদের কখনও ওস্তাদ, গুরু বা শিক্ষাগুরু বলা হয়। শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। কেননা একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন তার অনুসারীদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দিতে। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধকে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বি^ত করেন। স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
একজন শিক্ষক বা শিক্ষকতুল্য গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নেয়নি; সমাজে এমন মানুষ খুবই বিরল। একজন মানুষ যে পেশারই হোক না কেন, সে কারও না কারও কাছ থেকে লব্দ জ্ঞান অন্বেষণ করেই সামনে পথ চলা শিখে। একজন মিস্ত্রি যখন কারও কাছ থেকে কাজ শিখে কাঠের কারুকার্য করে, সেই তার ওস্তাদ বা শিক্ষক। আক্ষরিকভাবে কাউকে শিক্ষিত করে তোলাই একজন শিক্ষকের একমাত্র কাজ নয়, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলাও একজন শিক্ষকের কাজ। তাই একজন ব্যক্তি স্বশিক্ষিত হোক বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত হোক, সে কোনো না কোনো শিক্ষকের সান্নিধ্যে অবশ্যই এসেছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হয়ে গৃহশিক্ষা নিয়ে সুশিক্ষিত হয়, তবে তার পিতামাতা বা গৃহ শিক্ষকই তার শিক্ষাগুরু এবং তার মাধ্যমেই শিক্ষার হাতেখড়ি শুরু হয়েছে। একজন ব্যক্তি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদেও আসীন হয়, তারপরও তিনি তার পূর্বতন স্কুল বা কলেজের শিক্ষকের কাছে সারাজীবনই ছাত্র। এটাই একজন শিক্ষকের বড় অর্জন, মহত্ত্ব ও সাফল্য।
শিক্ষকরা হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর ও জাতির বিবেক। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে মা-বাবার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। শিক্ষকরা হচ্ছে জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। এক কথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে অর্থবহ করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়। একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষক সত্যিকারভাবে সমাজ বদলে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। আদর্শ শিক্ষকই শুধু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারেন। জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। মহান আল্লাহতায়ালাও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। মহানবী (সা.) ঐশী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানবজাতিকে সৃষ্টিকর্তা, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষাদান করেছেন। তিনি নিজেই এ পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করেছেন, ‘শিক্ষক হিসাবে আমি প্রেরিত হয়েছি’ (ইবনু মাজাহ, ২২৫)।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে, দিল্লির বাদশা আলমগীরের সন্তান শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলেছিল বলে বাদশা শিক্ষককে ডেকে তিরস্কার করেছিলেন এই বলে, আপনি তো আমার ছেলেকে আদব-কায়দা কিছুই শেখাননি। যদি তা শিখত তাহলে সে আপনার পায়ে শুধু পানি ঢালত না; হাত দিয়ে পা পরিষ্কার করেও দিত। কাজী কাদের নওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদা কবিতায় শিক্ষকের মর্যাদার যে প্রতীকী রূপকল্প তৈরি করা হয়েছে, শিক্ষকের সে মান-মর্যাদা আজকের দিনে হয়তো অকল্পনীয়। কিন্তু সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা এখনও একেবারে হাওয়ায় উড়ে যায়নি কিংবা পানিতে ডুবে যায়নি। সে কারণে কিছুদিন আগেও একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক একজন প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিজের কান ধরে ওঠবস করে শিক্ষকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে এবং এ রকম ঘৃণ্য কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। এগুলো হচ্ছে উপসর্গ, যা সমাজে শিক্ষকের জায়গা এখনও একটা মর্যাদাকর স্থানে রাখা আছে, তাকে প্রতীকী প্রতিবাদ করে।
শিক্ষকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ছাত্রের চরিত্রের ক্রটি সংশোধন করা। যার সংশোধন করা হবে তার প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতি থাকা আবশ্যক। ছাত্রদের মঙ্গল করার ইচ্ছা থেকেই এ সহানুভূতির জš§ নেয়। যদি ছাত্রদের ভালো করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে তাকে শিক্ষা দেয়ার কোনো অর্থ নেই। সোহাগ, আদর, স্নেহ এ ধরনের অনুভূতির পেছনে মঙ্গলের ইচ্ছাই কাজ করে। আর যদি এ ইচ্ছা থাকে তাহলে কোনো কোনো ত্রুটি সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনো অকল্যাণ কাজ করতে পারে না। আর যদি সোহাগ থাকে তাহলে শাসনের মধ্যে কল্যাণ অবশ্যই ফুটে উঠবে। অর্থাৎ শিক্ষকের আদর্শ হওয়া উচিত পাপকে ঘৃণা করা পাপীকে নয়। এ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সোহাগের মনোভাব নিয়ে শিক্ষা দান করলে সেটা শিক্ষকের জন্য কল্যাণ বৈকি, অমানবিক হবে না।
তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য, সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ক্রমেই পতনশীল। যদি পাইকারি হারে সমাজের অধঃপতনকে শিক্ষকের প্রতি সমাজের মর্যাদা হ্রাসের কারণ হিসেবে দায়ী করি, তা হবে নির্ভেজাল পক্ষপাতদুষ্ট বিবেচনা। কেননা, শিক্ষক নিজেরাই কি খানিকটা এ মর্যাদাহানির জন্য দায়ী নয় শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দানের পরিবর্তে রাজনৈতিক চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, দল উপদলে বিভক্ত হচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সামাজিক অবক্ষয় আঁকড়ে ধরেছে। আজকের দিনের শিক্ষক আর দিল্লির বাদশা আলমগীরের যুগের শিক্ষকের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সক্রেটিসও শিক্ষক ছিলেন। সক্রেটিসকে বলা হয় শিক্ষকদের শিক্ষক।
শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি চমৎকার শিক্ষণীয় পোস্ট দেখলাম। সেখানে বলা হয়েছে, একবার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা ওমান সফরে গিয়েছিলেন। সেদিন এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান যখন ওমানে অবতরণ করল তখন তিনটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল। তৎকালীন ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ সাধারণত কখনোই কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যেতেন না। অথচ সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওমানের রাজা রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গেলেন।
বিমান যখন রানওয়ে স্পর্শ করল তখন রাষ্ট্রপতি সিঁড়ি দিয়ে অবতরণ করলেন না, বরং ওমানের রাজা নিজেই সিঁড়ি বেয়ে উড়োজাহাজে উঠে গেলেন এবং তিনি নিজে রাষ্ট্রপতিকে সিট থেকে স্বাগত জানিয়ে সাথে করে নিচে নেমে এলেন। উড়োজাহাজ থেকে নামার পর মি. শর্মা দেখলেন অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটি সুসজ্জিত গাড়ি। শঙ্কর দয়াল শর্মা এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। আর তখনই ওমানের রাজা চালককে ইশারা করলেন অন্য গাড়িতে গিয়ে বসার জন্য, কারণ তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে যাবেন তাঁর নিজ বাসভবনে। এসব দেখার পর কৌতূহলী, বিস্মিত সাংবাদিকরা সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি একই সঙ্গে এতগুলো রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল ভাঙলেন কেন রাজা মৃদু হেসে জবাব দিলেন। আমি আজ ভারতের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে যাইনি। আমি নিজে ভারতবর্ষে পড়াশোনা করেছি। বহু কিছু শিখেছি ওই দেশ থেকে। যখন আমি পুনেতে পড়াশোনা করতাম তখন মি. শর্মা আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। শুধু এ কারণেই আমি উনাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে এতগুলো প্রটোকল ভেঙেছি। এটাই একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও মর্যাদা। একজন শিক্ষকের সম্মান ও স্থান রাষ্ট্রপতিরও ঊর্ধ্বে।
একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের প্রাণ। তাকে ঘিরেই পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়। তাই তার দায়িত্ব-কর্তব্যও অনেক। তবে একজন শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো শিক্ষার্থীকে আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক। বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে তার ভূমিকা অপরিসীম। তিনি জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে থাকেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও সুনাম শুধু বিদ্যালয়ের আঙিনায় বিদ্যমান থাকে এমনটি নয়। একজন শিক্ষকের কাছে অভিভাবকদের প্রত্যাশা থাকে আকাশসম এবং একজন আদর্শ শিক্ষকও তার সর্বোচ্চটুকুই দেয়ার চেষ্টা করেন। আদর্শ শিক্ষকই আদর্শ মানব সৃষ্টির শৈল্পিক কারিগর। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, নির্দেশনা এবং আদর্শ, স্থান, কাল, পাত্র, জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কল্যাণে ব্যাপৃত হয়। তাই বলা হয় ব্যক্তি মানব এখানে অর্থহীন কিন্তু ব্যক্তি শিক্ষক সকলের শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। একজন শিক্ষকের শিক্ষাদর্শন সার্বজনীন কল্যাণকর। একে নির্ধারিত ফ্রেমে আবদ্ধ করা যায় না। কাজেই শিক্ষকের দায়িত্ব কর্তব্যকে শুধু বিদ্যালয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তিনি সমাজ এবং রাষ্ট্রের পর্যায়েও বহুবিদ দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পন্ন করে থাকেন। এ জন্যই তার মান, মর্যাদা ও সম্মান সর্বব্যাপী এবং সবার শীর্ষে।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক
zrbbbp@gmail.com