শিক্ষক লাঞ্ছনার কারণ ও প্রতিকার

আশিকুর রহমান সাকিব: শিক্ষকরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। শিক্ষকরা দেশ, সমাজ ও জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। একটি আদর্শ নৈতিক ও দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। বলা হয় শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকরা সেই মেরুদণ্ডকে সুস্থ-সবল ও সঠিকভাবে নির্মাণ করেন। একটি শিশু তার পারিবারিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে, মক্তব বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ করে। নৈতিকতার শিক্ষা প্রথমে পরিবার থেকে লাভ করার পর এই শিক্ষকরাই তাকে নৈতিকতার উচ্চতর পাঠদান করেন।

পিতামাতার সন্তান জš§দান ও লালনপালন করলেও একজন শিক্ষক ও শিক্ষিকা সেই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন। সেজন্যই শিক্ষককে দ্বিতীয় জš§দাতা হিসেবে তুলনা করে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর কবিতার ছন্দে লিখেন-

‘ওস্তাদে প্রণাম কর পিতা হন্তে বাড়,

দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।”

কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকদের মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতায়, বাদশাহ আলমগীর তার সন্তানের শিক্ষকের যে মর্যাদা দিয়েছেন তা পৃথিবীতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের সামনে নিজেকে একজন আদর্শবান, নৈতিকতা সম্পন্ন ও অনুকরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করবেন। যাতে ছাত্ররা তাদের জীবনের আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষকরা একজন ছাত্রকে শুধু পাঠদান করাবেন না, পাশাপাশি তাকে নৈতিক জীবনচর্চার উজ্জ্বলতম দিকগুলো বাতলিয়ে দেবেন। সেই পাঠ অবলম্বন করে ছাত্র তার জীবন পরিচালনা করবে। একজন ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষে উচ্চ আসনে অধিকার করেও তার শিক্ষককে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবে এটাই ছিল চিরাচরিত রূপ।

শিক্ষকের সেই মর্যাদা আজ ধুলায় গিয়ে মিশেছে। সেই শিক্ষকরা আজ নিজ শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছে। শুধু শিক্ষার্থীদের দ্বারাই নয়, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতারাও একশ্রেণির কুচক্রী মহলের দ্বারাও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।

সম্প্রতি নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা গলায় দিয় ঘুরানো হয়েছে ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে। এই ন্যক্কারজনক কাজটি যে সংঘটিত করেছে সে এই শিক্ষককে একসময়ে ছাত্র। ২৩ জুন ২০২২ সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই ছাত্র জিতু। এই জিতু একজন বখাটে ছেলে। সে ছাত্রীদের রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করত। তাকে এই অপরাধের বিচার করলে সে খোদ তার শিক্ষককেই পিটিয়ে হত্যা করে। ২০২১ সালের ৩০এ নভেম্বর, খুলনার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ড. মোহাম্মদ সেলিম হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে তার মৃত্যুর কারণ মানসিক পীড়ন। আর তাকে এই পীড়িত যারা করে তারা হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২০ মার্চ ২০২২, মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার বিনোদপুরের রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের হƒদয় মণ্ডলকে অপদস্ত করা হয় ধর্ম অবমাননার দায়ে। পরে পুলিশ তাকে মামলা দেখিয়ে জেলে পাঠালে ১৯ দিনের মাথায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে তার জামিন হয়।

সম্প্রতি রাজশাহীতে এক সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে একজন শিক্ষককে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের একজন স্কুল শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছে ধর্ম অবমাননার দায়ে।

সাধারণ শিক্ষক ও সংখ্যালঘু শিক্ষকদের প্রতি এই ন্যক্কারজনক জনক ঘটনাবলি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। কুচক্রী মহল এই কাজগুলো পরিকল্পিতভাবে ঘটাচ্ছেন কি না তা ভালো করে তদন্ত করে দোখার বিষয়। হিন্দু মুসলমানদের দীর্ঘদিন সম্প্রীতির সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে নতুন করে এই দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সৃষ্টি করাই হলো এদের পরিকল্পনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব অপরাধীকে ধরতে সচেষ্ট হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের সার্বিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার পেছনের খোদ শিক্ষকদের দায় কম নয়। শিক্ষকরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। নিজেদের নিজেদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংঘঠন হিসেবে পরিচিত করেন। শিক্ষাদান ও গবেষণা ছেড়ে শিক্ষকদের এই রাজনীতিপরায়ণ হওয়াটা আমাদের দোশের শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার অন্যতম কারণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের পদগুলোতে, যখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের মতাদর্শের লোকদের পদায়ন করা এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় তখন সার্বিকভাবে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যায়। শিক্ষকরা শিক্ষাদান ও গবেষণা রেখে পদ-পদবীর লোভে রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি বাড়তে থাকে। ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার মান নিন্মমুখী হয়।

তাই শিক্ষকদের ওপর লাঞ্ছনার ঘটনা আকস্মিক কোনো বিষয় নয়। এটার কারণ হলো সামাজিকভাবে শিক্ষকদের মান মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার। চরিত্রহীন লম্পট শিক্ষকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদান করা। ছাত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার মতো মারাত্মক কারণগুলো রয়েছে। এভাবে নৈতিকতাহীন, চরিত্রহীন, শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কোনো আদর্শিক শিক্ষা পাচ্ছে না। ফলে এই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জায়গায়টা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। তাইতো দেখছি ছাত্রদের শাসন করার কারণে ছাত্র তার শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে। তাই, সার্বিকভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনা সুষ্ঠ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ধর্মীয় বিষয়গুলোতে আঘাত দিয়ে কোনো বিষয় বলা ও করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ধর্ম অবমাননার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে অবমাননাকারীকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা সম্পন্ন, চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়