প্রতিনিধি, রাবি: শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মান নেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ৪৭টি বিভাগে। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদ- ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। তবে এ মানদ- বজায় রাখতে ব্যর্থ রাবির ৪৭টি বিভাগ। সেখানে ৩৫ শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৫৩টি বিভাগ এবং ৭টি ইনস্টিটিউটে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এগুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগ। এরপরের অবস্থানে ইতিহাস বিভাগ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাবিতে ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগে ছাত্র ৪৬২ ও ছাত্রী ১৩৫ জন। এ বিভাগে মোট শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৯৭ জন। বিপরীতে পাঠদানে নিয়োজিত মাত্র ৭ জন শিক্ষক। সে হিসাবে বিভাগটিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৮৫। অর্থাৎ প্রতি ৮৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিভাগটিতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১ জন। যা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের মানদ-ের ধারেকাছেও নেই।
ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স বিভাগের পরের অবস্থানে রয়েছে ইতিহাস বিভাগ। এ বিভাগে এক হাজার ৪৭ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৩ জন। বিভাগটিতে ৮১ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে পিছিয়ে থাকার দিক থেকে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন আইন ও ভূমি প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। এ দুই বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গড় অনুপাত ১:৬৬। অর্থাৎ প্রতি ৬৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিভাগটিতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১ জন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৩টি বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মান রয়েছে সেগুলো হলো-সংগীত, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ফার্মেসি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিশারিজ এবং ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স বিভাগ। এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজেও আন্তর্জাতিক মান রয়েছে। ১১টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ৪৭টি বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের আন্তর্জাতিক মান নেই।
তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ। এ বিভাগে ৪৭২ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন ৪৫ জন শিক্ষক, অর্থাৎ প্রতি ১৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক রয়েছেন।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাবিতে মোট ৩৮ হাজার ২৯১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১ হাজার ৯৭ জন। অর্থাৎ প্রতি ৩৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে এখানে একজন করে শিক্ষক আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষক সংখ্যা কম। তবে শিক্ষক বাড়লেই যে শিক্ষার মান বাড়বে এমনটাও মানতে নারাজ তারা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ থাকায় শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত কম। তাছাড়া বর্তমান যে পদ্ধতিতে পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে এ অনুপাত সমস্যা নয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলেন, শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত কম থাকার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে। যথাসময়ে নিয়োগ দিতে না পারা বা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অস্বচ্ছতা থাকাকে দায়ী করছেন তিনি। যথাসময়ে নিয়োগ দিয়ে এবং আস্থার জায়গা তৈরি করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, বিভিন্ন জটিলতায় শিক্ষক নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় রাবিতে শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত অনেকটাই কম বলে তিনি মনে করছেন। সামনের দিনগুলোতে শিক্ষকের অনুপাত কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সুলতান-উল-ইসলাম জানান, ‘শিক্ষক নিয়োগ দিলেই যে শিক্ষার মান বেড়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। আমাদের যে সংখ্যক শিক্ষক আছে তারা সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের পরিচর্যা করলে শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, কোনো ডিপার্টমেন্টে যদি শিক্ষক সংকট থাকে তাহলে ওই বিভাগের সভাপতি প্রশাসনকে অবগত করবেন। তাছাড়া দ্রুত সময়ে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পাস হয়ে গেলে শিক্ষক অনুপাতের সংখ্যা কিছুটা কমে আসবে বলেও জানান এ উপ-উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বলেন, ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক অবস্থা তুলে আনে এবং তাগিদ দিয়ে থাকে। ইউজিসির অনুমোদন নিয়ে শিক্ষক সংখ্যার সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষার্থী ভর্তি করলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরিকল্পনার অভাবেই এমনটি হয়েছে বলে জানান তিনি।