আলী আহসান:‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার’Ñএই কথাগুলো আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। সর্বজনীন এই উক্তিগুলো উল্লেখ করার মূল লক্ষ্য হলো আমরা প্রতিনিয়ত আশা করি আমাদের সমাজ হয়ে উঠবে একটি শিক্ষিত সভ্য সমাজ। একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ার পেছনে অন্যতম মূল কারিগর হলেন শিক্ষক।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। সমাজের প্রতিটি মানুষই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কার্যাবলীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সমাজে সাধারণ একজন ব্যক্তির সামগ্রিক কার্যাবলি অর্থকে প্রাধান্য দিয়েই সম্পাদিত হয়। কাজেই সমাজের সাধারণ নাগরিক হিসেবে একজন শিক্ষক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। যদিও আমরা শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থটি উপেক্ষা করে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরি সমাজ ব্যবস্থায়। বিষয়টি এতটাই প্রকট হয়ে গেছে যে, আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক ধারণা জšে§ছে যে অর্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে শুধু আমাদের সমাজকে শিক্ষিত করে তোলাই একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ।
সমাজ সভ্যতার অন্যতম সারথি হিসেবে শিক্ষকদের তুলে ধরতে গিয়ে আমাদের সমাজ ভুলে যায় যে, শিক্ষকরাও রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। উদ্ভিদ ও রক্তে মাংসে গঠিত প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য একটি উপাদান। এ কথাগুলো বলার মূল কারণ হলো আমাদের দেশে প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি বেতনভুক শিক্ষক ছাড়া এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। তাদের বেতনের পরিমাণ এতটাই কম যে চার-পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচও তার থেকে তুলনামূলক বেশি।
বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণ বিস্তর ফারাক। এই বৈষম্যটি কমানোর জন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন অনশন করে যাচ্ছে। কিন্তু এই বৈষম্য কমানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাননি শিক্ষকরা। এ কারণে ধীরে ধীরে শিক্ষকদের ক্ষোভ বেড়েছে। কাজেই এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সুযোগ-সুবিধা নয়; বরং আরও বড় দাবি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ চান। মূলত তাদের দাবি, এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করতে হবে। এ দাবি নিয়ে শিক্ষকরা গত মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় এসে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। আন্দোলনত শিক্ষকরা বলেন, দাবি আদায় না করে স্কুলে ফিরে যাব না। তারা স্কুলে তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে এসেছেন। ফলে বিশেষ করে মফস্বল ও গ্রামের অনেক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এ কর্মসূচিতে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের অংশগ্রহণও বাড়ছে।
এখন সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রশ্ন সৃষ্টি হতেই পারে যে শিক্ষদের এই আন্দোলন কতটুকু যৌক্তিক?
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একজন সরকারি শিক্ষকের সর্বনি¤œ প্রারম্ভিক বেতন ১৬ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা মূল বেতনের ১০০ শতাংশ, বাড়ি ভাতা মূল বেতনের ৪৫-৫০ শতাংশ, অবসরকালীন বেতন মূল বেতনের ৯০ শতাংশ সঙ্গে মাসিক ভাতা, অবসরকালীন ভাতা মূল বেতনের ৯০ শতাংশের ৩০০ গুণ আর এই অবসরকালীন বেতন ভাতার জন্য সরকারি শিক্ষকরা আলাদা কোনো চাঁদা প্রদান করে না। এছাড়া সরকারি শিক্ষক সুবিধামতো স্থানে চাকরি বদলের সুযোগ পায়।
অন্যদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া বাবদ পায় মাত্র ১ হাজার টাকা অবসরকালীন ভাতা মূল বেতনের ৭০ গুণ। তবে অবসর নেয়ার পরে আর কোনো বেতন পায় না অথচ অবসরকালীন সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ চাঁদা দিতে হয়।
এছাড়াও তারা চাকরি বদলির সুযোগ পায় না। সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের উপর্যুক্ত সমীকরণে স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়।
২০২৩ সালের তথ্যসূত্রে জানা যায়, এমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে ৪০০৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৯ হাজার ৮৪৮টি এবং মাদরাসা রয়েছে ৯ হাজার ৩৪১টি অর্থাৎ এমপিওভুক্ত মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯ হাজার ৯২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের সংখ্যা হলো কলেজ পর্যায়ে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৩৭ জন, মাধ্যমিকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন, মাদরাসায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৬৮ জন এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২ হাজার ৩৭৮ জন। সব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা হলো ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৪ জন। কাজেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৃহৎ একটি অংশজুড়ে রয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।
সরকারি তথ্যমতে, এমপিওভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আয়কৃত অর্থের গাণিতিক পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যদি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী প্রতি মাসে সর্বনি¤œ ২০ টাকা বেতন দেয়, তবে মোট শিক্ষার্থীর থেকে বার্ষিক প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৯০ কোটি টাকা। যদিও আমাদের দেশে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থী আরও অনেক বেশি টাকা মাসিক বেতন প্রদান করে। এছাড়া ভর্তি ফি, সেশন ফি হিসেবে যদি একজন শিক্ষার্থী ৪০০ টাকাও প্রদান করে, তবে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ৬৫০ কোটি টাকা, যদিও বাস্তবিকে সেশন ফি প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এছাড়া অন্যান্য খরচ বাবদ এমপিওভুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যদি ৫০ হাজার করে আয় করে তবে সব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ২০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে আবার লক্ষণীয় বিষয় এই যে, বর্তমানে সরকার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান বাবদ বার্ষিক ব্যয় করেন ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। অর্থের সব গাণিতিক পরিসংখ্যান বলছে, একটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ হলো ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা অথচ জাতীয়করণের জন্য প্রয়োজন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কাজেই সুস্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সময়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের যে দাবি তুলেছেন তা অযৌক্তিক নয়। বরং যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা হয় তবে সরকারের ১৬৫ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। অন্যদিকে আবার ২০ টাকা বেতনে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারবে। দরিদ্রতাকে জয় করে সমাজের শিক্ষা ও সাক্ষরতার হারও বাড়বে।
সর্বোপরি দেশের একজন সুনাগরিক ও কল্যাণকামী হিসেবে বলতে চাই শিক্ষা ক্ষেত্রে আর্থিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত নানান ধরনের বৈষম্য হ্রাস হোক। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর হোক সমাজের মাথা উঁচু করে বাঁচুক। কেননা একজন শিক্ষক যদি সমাজের সব বৈষম্যের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, তবেই প্রফুল্ল চিত্তে উদার মানবিকতার আহ্বান করতে পারবে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে। ফলাফলস্বরূপ, এদেশ হয়ে উঠবে শিক্ষিত, সভ্য, অপরাধমুক্ত বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়