ইয়াছিন আরাফাত: শিক্ষা জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার চাবিকাঠি। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তাচেতনার অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কোনো মানুষ বা প্রাণী সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়াও কোনো জাতি, দেশ উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে না, কখনও পারবেও না। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। কিন্তু দেশের এ কারিগরদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার একমাত্র প্রধান মাধ্যম হলো শিক্ষা। যে শিক্ষা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হবে, সেই শিক্ষাই যদি ত্রুটিযুক্ত ও তলাবিহীন ঝুড়ি হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা আর কী শিখবে? আর কী বা জাতিকে দিবে? আজ দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা দিন দিন শিক্ষাব্যবস্থাকে কঙ্কালরূপে পরিণত করেছে। শিক্ষাব্যবস্থার এমন কঙ্কাল হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় সবচেয়ে দায়ী, নিচে সেগুলো তুলে ধরছি।
যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষা না থাকা: কারিগরি শিক্ষা জাতিকে সুশিক্ষিত ও বেকারত্বমুক্ত জাতিতে রূপ দান করতে শতভাগ সহায়তা করবে। যদিও যুগোপযোগী ও কারিগরি শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবিক এর কোনো আশানুরূপ সুফল দেশের মানুষ পায়নি। তাইতো দেশের মানুষ এখনও হতাশার গ্লানি সহ্য করছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, শিক্ষা আমাদের অগ্রাধিকার কিন্তু কারিগরি শিক্ষা হলো অগ্রাধিকারের অগ্রাধিকার। কারিগরি শিক্ষা ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা পূরণ হবে না। কারিগরি শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পেছনে প্রয়োজন একদল সাহসী জ্ঞানযোদ্ধা গবেষকের। যাদের গবেষণার প্রধান ও প্রণিধানযোগ্য কাজ হবে, কারিগরি শিক্ষার সুফল দেশজুড়ে তুলে ধরে জনমনে আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসেবে দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ। এ বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ আর আট লাখ ৩০ হাজার নারী।
এছাড়া দেশের কারিগরি শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীরা যোগ্য এবং দক্ষ নাগরিক তৈরি না হয়ে, বরং বেকারত্বের চাপই যেন দিন দিন ভারী করছে। আজকাল আইটি সেক্টরে যোগ্য জনবলের অভাবে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, ইউরোপের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশি প্রবাসীদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে আছে। তাই জাতির কল্যাণেই যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষার উৎকর্ষ নিয়ে ভাবতে হবে।
নকলনির্ভরতা: দেশের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় নকলনির্ভরতা বেড়েছে। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাগুলোতে নকলের নাগফাঁসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা না করেই পাস করে ফেলছে। নিজেদের মেধা ও যোগ্যতাকে যাচাই করতে এসে তারা উল্টো চুরি বিদ্যা শিখে বাড়ি ফেরত যাচ্ছে, যা কখনোই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার নড়বড়ে কাঠামোই দায়ী বলে বিশ্বাস করছি, কেননা এ নকল সরবরাহ করার পেছনে যাদেরই হাত তারাই হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা। তাদের জবাবদিহি ও খোদাভীরুতার অভাব এবং বিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোয় সব অধ্যায়-অনুচ্ছেদ ছাত্র-ছাত্রীদের না পড়ানোর দায় এড়াতে, এমন জঘন্য নি¤œ কাজে তাদের অবদান আজ পরিলক্ষিত। কিছু কিছু সময় এমনও দেখা যায় যে, ছাত্রকে পাস করানোর হীন অপচেষ্টায় শিক্ষক তার নিজের ব্যক্তিগত স্বকীয়তা, সম্মান, মর্যাদা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়ে বসেন। এমনও শিক্ষাগুরু রয়েছেন যিনি ছাত্রছাত্রীদের নকল প্রদান করতে গিয়ে, ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা পড়ে কারাবরণ করেছেন। আজকে দেশের লাখ লাখ জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থী বেকারত্বের গ্লানি মাথায় নিয়ে দেশ ও জাতির সামনে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা তারা বিদ্যা শিখতে গিয়ে চুরি শিখেছে।
সৃজনশীল শিক্ষার পরিবেশের অভাব: আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বসবাস করছি। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে আজ সৃজনশীল মেধার ব্যাপক অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তারা সৃজনশীল মেধা সৃষ্টির কোনো চিন্তা নিজেদের মাথায় আনতে পারে না। সর্বদা মুখস্থনির্ভর এবং পরনির্ভরশীল হয়ে ছাত্রজীবন শেষ করছে। দেশের উন্নতি তত দিন সম্ভব হবে না, যত দিন এ দেশের শিক্ষায় সৃজনশীলতার প্রকাশ না ঘটবে। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক তৈরির জন্য সৃজনশীল মেধার বিকল্প অন্য কোনো আছে কি না, আমার জানা নেই। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব সাধন করতে শিক্ষাব্যবস্থাকে কঙ্কাল মুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে। সৃজনশীল মেধা বিকাশে নানামুখী যথোপযুক্ত কর্মসূচির প্রয়োজন। যেমন: শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজনের পাশাপাশি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতার উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতা, ক্লাবের আয়োজন করা জরুরি।
গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার অভাব: শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো গবেষণা। গবেষণা ছাড়া শিক্ষা তার পূর্ণতায় কখনও পৌঁছাতে পারে না। অপরের দিকে গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ আমাদের দেশে না থাকায় দেশের অধিকাংশ মেধাবী ছাত্ররা এমফিল পিএইচডি গবেষণা করতে বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশের বাইরে অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তারা আর দেশে ফিরে আসতে চায় না।
এতে করে দেশের মেধাশূন্যতা পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রতি বছর ৬০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিদেশের দরজায় কড়া নাড়ে। এদের বৃহৎ অংশই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। গ্র্যাজুয়েট শেষ করে তারা ওই সব দেশেই স্থায়ী বাস করতে শুরু করে। তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি বিশ্বমানের পাঠদান করাতে ব্যর্থ? যদি ব্যর্থই হন তাহলে এমন শিক্ষাব্যবস্থার কী প্রয়োজন? যা প্রায় অর্ধমৃত। এছাড়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হলো চাকরি বিমুখ। যার দরুন প্রতিনিয়তই বেকারের হার বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে গবেষণার বিকল্প কিছুই নেই।
সর্বোপরি, শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনরূপে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। নচেৎ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও শিক্ষার উন্নতি না হলে দেশের মেরুদণ্ড যে কোনো সময়ে ভেঙে পড়তে বাধ্য হবে। দেশের সুনাম সুখ্যাতি অক্ষুণœ রাখতে যুগোপযোগী ও আধুনিক সৃজনশীল এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষাব্যবস্থাকে কঙ্কাল মুক্ত করে সত্যিকার ও কার্যকরী এবং সময়োপযোগী শিক্ষার জোর দাবি জানাই।
শিক্ষার্থী
আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়