বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি

শিক্ষার কথা বলে অথচ দাম বাড়ায় কলমের

নিজস্ব প্রতিবেদক : আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘বাস্তবতা বিবর্জিত, প্রতারণামূলক, লোক দেখানো’ হিসেবে বর্ণনা করে কলমের ওপর ভ্যাট আরোপের উদাহরণ টেনেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেছেন, ‘সরকার শিক্ষার কথা বলে অথচ দাম বাড়ায় কলমের, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে দাম বাড়ায় ল্যাপটপ-মোবাইল ফোনের, গরিবের কথা বলে অথচ পরোক্ষ কর আরোপ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর।

‘এটি স্পষ্টতই জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এই বাজেটে সাধারণ ও দরিদ্র জনগণের জন্য কোনো সুখবর নেই, নেই চরম অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের কোনো দিকনির্দেশনা।’

জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব করার ছয় দিন পর গতকাল বুধবার দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন।

বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, তা ‘অর্জনযোগ্য নয়’ বলেও মনে করেন ফখরুল।

গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে তিনি গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মোটা দাগে এই বাজেট আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর শর্ত বাস্তবায়ন এবং বিগত অর্থবছরের বাজেটের ১৪-১৫% বর্ধিত অবস্থা ছাড়া কিছুই না।”

মূল্যস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব প্রাপ্তি, ‘আয়-বৈষম্য’, করারোপে ‘বৈষম্য’, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ, বাজেট বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দের সঙ্গে ‘বাস্তবতার’ বিশ্লেষণ তুলে ধরেন তিনি।

ফখরুল বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। এই চাপ মোকাবেলায় প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কোনো কাযর্কর পদক্ষেপ নেই।

‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন, খাদ্যসহ তেল, চাল, আদা, চিনি, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অনেক আগেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পথরেখা না দিয়েই কীভাবে মূল্যস্ফীতির টার্গেট ৬ শতাংশ ঘোষণা করেছেন তা বোধগম্য নয়।’

বাজেটে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলেও

মনে করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার বলয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের অনুকূলে এই বাজেট কোনো ভূমিকা রাখবে না। এটা গণবিরোধী বাজেট।’

‘স্মার্ট বাংলাদেশে এবার তারা স্মার্ট লুটপাটের বাজেট দিয়েছে। তারা চুরিতে স্মার্ট। ভোট চুরি, ব্যাংক চুরি, অর্থ পাচারÑএসব কিছুতেই স্মার্টলি লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করার, ব্যাংক লুটপাট, সিন্ডিকেট পরিচালনা, জনগণের সম্পদ লুটের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে এই বাজেটে।

‘এ দেশটাকে লুটপাটের অংশীদার বানানো হয়েছে। সে জন্য বলতে চাই, এটা স্রেফ দুর্নীতিবাজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটের লক্ষ্যে প্রণীত অর্থ লুটেরাদের বাজেট।’ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমানোরও সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি দাবি করে তিনি বলেন, ‘বাজেট ও জিডিপির অনুপাতে এই খাতে বরাদ্দ কমেছে। বরাদ্দ বেশি দেখানোর কৌশল হিসেবে এই খাতে এমন কিছু কর্মসূচি দেখানো হয়েছে; যা বাস্তবে সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা কর্মসূচি নয়।’

কৃষি খাতে ভর্তুকি, সঞ্চয়পত্রের সুদ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেয়া প্রণোদনার টাকাকে সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ হিসেবে দেখানোর সমালোচনাও করেন বিএনপি নেতা।

তিনি বলেন, ‘বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকায় প্রতিবন্ধীরা বিক্ষোভ করেছেন, পুলিশের পিটুনি খেয়েছেন।’

বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে এক প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমাদের প্রশ্ন টাকা গেল কই? সাধারণ মানুষ তো তাদের বিদ্যুতের বিল দিয়েই যাচ্ছেÑএখানে কেউ বাকি নাই এবং উচ্চ মূল্যে দিচ্ছে, প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। তাহলে কেন কয়লার জন্য এলসি খুলতে পারছে না? কেন গ্যাসের এলসি খুলতে পারছে না? কেন তেলের জন্য এলসি খুলতে পারছে না।

‘আমাদেরও প্রশ্ন এই টাকা কোথায় গেল? টাকাও নাই, ডলারও নাই। এই টাকা কোথায় গেছে আমরা সবাই জানি। বিদেশে সম্পদ কেনা হচ্ছে, সুইস ব্যাংকের টাকা রাখা হচ্ছে, তারপরে অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা রাখা হচ্ছে, এগুলো ইতোমধ্যে আমরা জেনেই গেছি। কারা এই টাকার মালিক, এটাও দেশের মানুষের কমবেশি জানা হয়ে গেছে।’

বিদ্যুৎ সংকট সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সারাদেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে সবার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অথচ উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের ফেরি করে বিক্রি করতে হবেÑ পার্লামেন্টে অহমিকা করেছে সরকার।’

বিদ্যুতের এই সংকটের মূল কারণ ‘দুর্নীতি ও লুটপাট’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট’ থেকে শুরু করে আদানি পর্যন্ত পুরোটাই লুটপাট।

‘আমরা সেমিনার করে বলেছিলাম, মাত্র ১০টি কোম্পানি যারা ক্যাপাসিটি চার্জের সবচেয়ে বেশি সুবিধা উপভোগ করছে। এরা সবাই সরকারের সঙ্গে জড়িত।’

বিদ্যুৎ খাতকে বেসরকারি খাতে ঠেলে দেয়া হয়েছেÑমন্তব্য করে একে ‘বড় ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করেন ফখরুল। তিনি বলেন, ‘যার ফলে আজকে এই সংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে প্রফিট ছাড়া আর কিছু কাজ করছে না।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।