Print Date & Time : 17 August 2025 Sunday 4:07 am

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট  করাও অপরিহার্য

 

ফারিহা হোসেন প্রভা: একটি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে শিক্ষাকে অভিহিত করা হয়। শিক্ষাই একজন মানুষের কেবল বেঁচে থাকার, পথচলার প্রক্রিয়াকে সহজতর, বর্ণিল, গৌরবোজ্জ্বল করে তুলতে পারে। এজন্য শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন সংযোজন, প্রযুক্তিনির্ভরতা, বিজ্ঞানমনস্কতার সন্নিবেশ হওয়া প্রয়োজন। সময় ও যুগের চাহিদাই শিক্ষায় এ পরিবর্তনের গুরুত্ব বহন করে। দেশে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, বিজ্ঞানমনস্কতায় কতটা উত্তীর্ণ, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা। তিনি আরও বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো বাইরের প্রকৃতি ও আত্মকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ মানবশিশুর জšে§র পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে নানা সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ হয়। উন্নত মানসিক বিকাশের ক্রমচর্চার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার পরিগঠনের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ঘটে। এজন্য বলা হয়ে থাকে দেহ, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশই শিক্ষা। এককথায়, পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে, নিজেকে জাতির উপযোগী যোগ্য, কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানবজীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এটি কখনোই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য।

বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারপরও আমাদের দেশে অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার হচ্ছেন। অনেকে তো বাইরের দেশে লেখাপড়া করে সেখানকার ইউনিভার্সিটির শিক্ষকও হচ্ছেন। আমরা রুচি, পোশাক, আচরণ, ভাষাসহ অনেক কিছুতেই উন্নত দেশকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে চাই না। আমাদের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বলে বিদেশে সম্মানের আসনে অবস্থান করছে। তাদের অভিজ্ঞতা শিক্ষা খাতে কাজে লাগানো যেতে পারে।

শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন সংযোজন সৃজনশীল পদ্ধতি। এতে শিক্ষার্থীকে বইয়ের প্রতিটি লাইন মাথায় রাখতে হয়। এ পদ্ধতি কোমলমতি শিক্ষার্থীকে একধরনের সংকটে ঠেলে দেয়। শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পদ্ধতি পুরোপুরি চালু করা গেলে নোট, গাইড, কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য থাকবে না। অথচ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলের নামে বেশি করে গাইড, কোচিং, নোট বইয়ের নির্ভরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

সৃজনশীল পদ্ধতির পক্ষে একটি কথা ছিল যে, বাজারে কোনো নোট বই থাকবে না। অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই ওই সব নোটবই থেকে প্রশ্ন করেন, পাঠদান করেন। বলা হয়েছে, এ পদ্ধতির মাধ্যমে পড়ালেখা ক্লাসেই শেষ হয়ে যাবে। বাস্তবতা হলো, অধ্যয়নের জন্য এখন কোচিং-টিউশন আর গাইড বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

অন্যান্য বিষয় থেকে শুধু বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ব্যবহারিক মার্কস একটু বেশি। এখানেও অনিয়ম। সারা বছর একটা ঢাউস আকারের ব্যবহারিক খাতা লেখানো হয়, শিক্ষার্থীরা চোখ বন্ধ করে তাতে লেখে। পাবলিক পরীক্ষায় খাতা জমা দিয়ে আসে এবং সত্যি করে বলতে কি, ওই পরীক্ষকের হাতে কিছু টাকা আড়ালে গুঁজে দিয়ে আসা হয়। তাতে মেলে ব্যবহারিকের পুরো নম্বর। বাস্তবে শিক্ষার্থীদের কিছুই শেখা হয় না।

আবার অনেক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষার খাতায় ঠিকমতো নম্বর দেন না তারা। স্কুলে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটান অনেক শিক্ষক। বিশেষ করে চুল, নখ, দাঁত, পোশাক, জুতা নিয়ে শিক্ষার্থীকে নির্মম শাস্তি, কান ধরে ওঠবোস, দাঁড় করিয়ে রাখা, সহপাঠীকে দিয়ে চড়-থাপ্পড় মারা থেকে শুরু করে স্কুলের বাইরে মাঠে রোদে সূর্যমুখী করে এবং বৃষ্টিতে দাঁড় করিয়ে শাস্তির নজির রয়েছে শহরে, গ্রামে সর্বত্র। সম্প্রতি চাঁদপুরে প্রকাশ্যে শাস্তির অপমানে এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। এ রকম আরও নজির আছে। এর দায় কার। এসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।

শিক্ষকদের কিছু আচরণ শিক্ষার্থীর ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করে, অভিভাবকদের কতটা শঙ্কিত, বিচলতি করে, তা সহজেই অনুমেয়। এখন শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষণের গিনিপিগ, তারা যেন রোবট হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গেলে অনেক শিক্ষকের কাছে যেতে হয়, অনেক কোচিং সেন্টারে যাওয়া লাগে। টিচার-কোচিংয়ের বেতন, তার ওপর স্কুল-কলেজের বেতন তো আছেই। উন্নত বিশ্বে প্রাইভেট-কোচিং পড়ানোর কোনো নিয়ম নেই। ওই দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা কি শিখছে না? স্কুল-কলেজ থাকতে আবার কোচিং কিসের? কিন্তু ক্লাসে কতটুকু  শেখানো হয়, এ প্রশ্নও যৌক্তিক। ক্লাসে ভালোভাবে পড়ানো ও সিলেবাস শেষ করানো হলে প্রাইভেট, কোচিং, গাইড বইয়ের দরকার হতো না। এসব অপরিহার্য করে তুলেছে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা। আবার বোর্ড পরীক্ষা দিতে গেলে সাজেশন ও মডেল টেস্টের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। গরিব মানুষের পক্ষে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে সন্তানের পড়ালেখা করানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার আগে ফরম পূরণের সময় অবৈধ উপায়ে নানা রকম হিসাব দেখিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রায়ই সংবাদপত্রে এ ধরনের খবর প্রকাশিত হয়।

একটি কথা প্রাসঙ্গিক যে, আমাদের দেশে যে বয়সে ছেলেরা ভিডিও গেম খেলে, অন্য দেশে সেই বয়সে ছেলেরা গেম তৈরি করে, সফটওয়্যার তৈরি করে, কোনো প্রোগ্রামে ভুল থাকলে সংশোধন করতে পারে। আমাদের সন্তানরা তা পারছে না। এতে বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে। দেখা যায়, সারা বছরই কারও না কারও পরীক্ষা লেগে আছে। আর পরীক্ষা মানে শুধু শিক্ষার্থীর একার পরীক্ষা নয়। সে সঙ্গে বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি পরিবারের সবারই যেন পরীক্ষা। এখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির শিশুও চৌদ্দ-পনেরোটা করে সাবজেক্ট পড়ছে। কৃষিবিদ্যা পড়ছে সব শিশু। বীজ বপন থেকে চারাগাছ, সার, মাছ চাষ প্রভৃতি। কিন্তু বড় হয়ে সে জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছে কজন। অনেক শিশু সারা দিন ফাস্টফুড খেয়ে খেলাধুলা বা শরীরচর্চা না করায় অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। আসলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই এ রকম হয়ে যাচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বসমাজে চলার উপযোগী, বিজ্ঞানমনস্ক, কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তাছাড়া বইনির্ভরতা, কোচিং, গাইড, টিউশননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নয়, প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষা। এটি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত।

‘শিক্ষা’ শব্দটি ব্যাপকভাবে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের জীবনেÑকর্মে, সভ্যতায়, উন্নয়নে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পথপরিক্রমায়। তাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা জাতীয় উন্নয়নের নিমিত্তে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট করাও অপরিহার্য।

ফ্রিল্যান্স লেখক