সোহেল রানা: শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। দেশের উন্নতির মূল। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। অসংগতিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগের সমাধান তো হয়ইনি, বরং অভিযোগের পাল্লা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। সম্পূর্ণ আলাদা তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়ের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ব্যয় বহনের সামর্থ্যরে সঙ্গে মিল রেখে তাই ইংরেজি মাধ্যম উচ্চবিত্তদের, মাদ্রাসা তুলনামূলকভাবে নিম্নবিত্তদের এবং সাধারণ শিক্ষা নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে কারিগরি শিক্ষা চালু হলেও সেটির জনপ্রিয়তা আশাব্যঞ্জক নয়।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে এই মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন সব সময়ই আছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যয় নির্বাহের ক্ষমতা না থাকায় শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য এ মাধ্যমে পড়ালেখা করা সম্ভব হচ্ছে।
মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা না হওয়ার পরও দেশে মাদ্রাসা এবং সেগুলোতে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। মূলত ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রম নিয়ে পরিচালিত মাদ্রাসা শিক্ষা দুটি উপধারায় বিভক্ত। আলিয়া মাদ্রাসায় জাতীয় পাঠক্রম কিছুটা অনুসরণ করা হলেও কওমিতে তা নেই বললেই চলে। ২০১৪ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্তরের মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল না থাকা ও কারিগরি জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে মাদ্রাসা থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এই বিপুল শিক্ষার্থী দেশের মূল কর্মশক্তিতে অধিকাংশ সময়ই উপেক্ষিত। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনা বা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের মূল কর্মশক্তিতে সম্পৃক্ত করার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি কর্মমুখী বা কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা শুরু হয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষাই আমাদের দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ার উপযোগী হলেও কিছুদিনের মধ্যেই সেটি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের আরেকটি উপধারা হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
দেশের মূল জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা নামে পরিচিত, যেটা শুধু নামেই নয়, মানেও সাধারণ। দিন দিন সেই সাধারণ শিক্ষার মান যে অসাধারণ গতিতে নিম্নমুখীএটি সচেতন নাগরিকদের মাথাব্যথার কারণ হলেও নীতিনির্ধারকদের কতটুকু চিন্তার কারণ হতে পেরেছে, তা পরিষ্কার নয়।
স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সাধারণ শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট। শিক্ষাব্যবস্থার কয়েকটি বড় পরিবর্তনের দিকে তাকালেই পরিকল্পনাহীনতার ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়। নব্বইয়ের দশকে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে বহু নির্বাচনি (টিক চিহ্ন/অবজেক্টিভ) প্রশ্নপত্র চালু করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রতি বিষয়ে মাত্র পাঁচশ প্রশ্ন পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কয়েক বছরেই মাত্র পাঁচশ প্রশ্ন থেকে বহু নির্বাচনি পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতির অসারতা বুঝতে পারায় বহু নির্বাচনি প্রশ্নকে উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এরপর আরেকটি বড় পরিবর্তন ছিল গ্রেডভিত্তিক ফল চালু করা। দুজন শিক্ষক একই খাতা দেখলে দু’রকমের নম্বর আসবে, এটিই স্বাভাবিক। মানবিক এ সীমাবদ্ধতা দূর করা এবং তখন প্রচলিত বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলে ‘বোর্ড স্ট্যান্ড’ করার কথিত ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ বন্ধ করার জন্য গ্রেডভিত্তিক ফল চালু করা হয়, যেটি ছিল অসাধারণ একটি উদ্যোগ। কিন্তু আবারও গ্রেডভিত্তিক ফলের সঙ্গে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখের প্রচলন পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে এবং একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবকে সামনে নিয়ে আসে।
পরবর্তী সময়ে আরেকটি বড় পরিবর্তন ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’র প্রচলন। যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া চালু হওয়া এ পদ্ধতি এখনও অনেক শিক্ষকের কাছেই পরিষ্কার নয় এবং অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই আতঙ্কের অন্য নাম। কোচিং, গাইড ও নোটবই থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার কথা বলে চালু করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ কোচিং ও গাইডের প্রতি শিক্ষার্থীর নির্ভরতা বাড়িয়েছে!
শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যার নব্য সংযোজন প্রশ্নপত্র ফাঁস। একসময় পরীক্ষায় নকল প্রচলিত ছিল। তখন নকল করত কম মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ‘কোনোমতে থার্ড ডিভিশন’ পাওয়ার জন্য। তারা কখনও মেধাবীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসত না। পারিবারিক বা সামাজিকভাবে ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্যও ছিল না। এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস শুধু গ্রহণযোগ্যই নয়, কখনও কখনও বাবা-মায়েরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সন্তানের হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। সারা বছর পরিশ্রম করা শিক্ষার্থীরা যখন দেখছেÑকম পরিশ্রম করা সহপাঠী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে তাদের চেয়ে ভালো ফল করছে, তখন তারা পড়ালেখার ওপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। কোনো জাতি যদি তার মেধাবী সন্তানদের মূল্যায়ন করতে না পারে, সে জাতির সামনে এগোনোর আশা না করাই ভালো।
সামঞ্জস্যহীন কয়েক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যর্থতা বা প্রশ্ন ফাঁস এখানেই শেষ নয়। অসঙ্গতি আসলে পরতে পরতে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা অথৈ সাগরে পড়ে! ধরা পড়ে যায় স্কুল-কলেজের সিলেবাসের দুর্বলতা বা জানার ঘাটতি। অবাক হয়ে তারা আবিষ্কার করে, ১২ বছরের পড়ালেখা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করার যোগ্য করতে পারেনি। আর আমরাও অবাক হয়ে দেখি, দেশে এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম! ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ১০ থেকে ১৪ শতাংশের ভেতরে দেখে দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে আওয়াজ ওঠে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার; কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মান বাড়ানোর দাবি ওঠে না।
দেশের অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা আলাদা ধরনের ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছয় মাসেরও কম সময়ের ভেতরে ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুতি নিতে হয়। একই বা কাছাকাছি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের জন্যও তা শুধু শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যরেই পরীক্ষা নেয় না, পরীক্ষা নেয় অর্থনৈতিক সামর্থ্যরেও যা শুধু অবিচার নয়, অন্যায়। দেশের দুই প্রান্তে একই সময়ে পরীক্ষা থাকায় যেমন অনেকের পক্ষেই পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না, তেমনই অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও সম্ভব হয় না অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম কেনা বা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যয়ভার বহন করা। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার মতো সমজাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় না, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রতি বছরই ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের কথা ওঠে, দ্বিতীয়বার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। দেশের লাখ লাখ উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীর অনিশ্চয়তা আমরা দূর করতে পারি না।
দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উচ্চশিক্ষা প্রসারে ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা না থাকায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই প্রশ্নবিদ্ধ। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ভালো, সেগুলোর খরচ আবার মধ্যবিত্তের সামর্থ্যরে বাইরে। মৌলিক অধিকার ‘মানসম্মত শিক্ষা’ তাই উচ্চবিত্তের জন্যই নির্ধারিত হয়ে পড়ছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ধরনের বিষয় পড়ানো হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ‘বাজার কাটতি’ কয়েকটি বিষয়, যেমন বিবিএ, সিএসই, ইসিই এগুলোর প্রাধান্যই বেশি। সরকারি বা বেসরকারি সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই বলার মতো মৌলিক গবেষণার কোনো সুবিধা না থাকায় সত্যিকারের মেধাবীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চাকরির বাজারে ঢুকে পাচ্ছে আরেক আঘাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সঙ্গে মিল নেই চাকরির রিকোয়ারমেন্টে! এমনকি সরকারি চাকরি, যেমন বিসিএস বা ব্যাংকগুলোতে পরীক্ষা দিতে হলে আবার নতুন করে নতুন সিলেবাসে পড়ালেখা শুরু করতে হচ্ছে। একই ব্যাপার বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও। চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ছাড়াই স্নাতক, স্নাতকোত্তর সনদ নিয়ে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে এবং একটি পর্যায়ে নিজেদেরকে পরিবার ও সমাজের বোঝা মনে করছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা বা চাকরির বাজার প্রতিটি ধাপে অসঙ্গতি। এটা দূর করার কোনো উদ্যোগ নেই। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা এক আশাহীন আপসের পথে হেঁটে কোনো রকমে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই যদি হতাশ হয়ে যায় দেশের আশা কোথায়?
ফ্রিল্যান্স লেখক
sohelrana.ibaÑgmail.com