Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 4:16 am

শিগগিরই কমছে না চালের দাম

নাজমুল হুসাইন: দেশে চালের দাম সর্বকালের রেকর্ড পর্যায়ে রয়েছে।  এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপাতত বড় কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের মজুতও কম। পাশাপাশি হাওরে বন্যা ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় দেশের চালের মিলগুলোয়ও মিলছে না কাক্সিক্ষত ধান। এতে তারা সরকারকে চাল দিচ্ছে না। এতে হতাশাজনক সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রম। ফলে খুব শিগগিরই চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

এ অবস্থায় সমাধান হিসেবে চালের আমদানিতে ঝুঁকেছে সরকার। তবে সেখানেও বড় বিপত্তি। বিশ্ববাজারে বেড়ে চলেছে চালের দাম, এমনকি আগামীতে বড় সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলে চালের দাম সহসাই কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এখনও অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভোক্তাকে চড়া দাম গুনতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার নিজে চাল আমদানির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বেশি দামে কেনা এসব চাল সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করতে হবে। গতানুগতিকভাবে ওএমএসের মতো সরাসরি বিক্রয়ের কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব চাল সরবরাহ হলে তা প্রাপ্তি কতটুকু নিশ্চিত হবে সেটা বড় কথা।

এদিকে সরকারের সামাজিক কার্যক্রম ও মজুত পরিস্থিতি স্বভাবিক পর্যায়ে আনতেও প্রচুর চালের প্রয়োজন। ফলে বাজারে খুব বেশি চালের সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এতে আমদানি করা এসব চাল বাজারে কতটুকু প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারবে তা এখন বড় প্রশ্ন।

বিআইডিএসের ইমেরিটাস ফেলো এম আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরকার চাল আনছে, সেটা কীভাবে বিক্রি করবে, তা সরকারের ব্যাপার। এরপরও তারা যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে তাতে জনগণের সেই সুফল পেতে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যেই তো ভোক্তারা আরও করুণ পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আসলে সরকারের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, যাতে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমদানির পদক্ষেপও কার্যকর প্রভাব ফেলবে না। দেশে চালের উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিবেচনা করলে চালের দর এমন পরিস্থিতিতে কখনই যায়নি।’

প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরাও বুঝে গেছেন সরকারের কাছে চালের বাজারে হস্তক্ষেপ করার মতো মজুত নেই। তাই তারাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে আমি মনে করি, ব্যবসায়ীরা যতটা সংকটের কথা বলছেন, বাস্তবে ততটা সংকট নেই। কিন্তু চালকল ও ব্যবসায়ীদের কাছে কত মজুত আছে, তাও সরকারের জানা নেই। ফলে তাদেরও কোনোভাবে বাধ্য করার মতো উপায় নেই সরকারের।’

এদিকে বেসরকারি খাতে চালের মিল মালিকরাও বলছে বাজারে সহসা চালের দাম কমার কোনোই সম্ভাবনা নেই। উল্টো আরও বাড়তে পারে সরু চালের দাম। এ মৌসুমের ইরি-বোরো চালের সংকট চলছে মিলগুলোয়। আর আগামী আউশ মৌসুমেও কাক্সিক্ষত চালের মজুত আসবে না। এদিকে ইরি-বোরোর সময় হাওরে বন্যা ও প্রতিকূল অবহাওয়ায় এখনও চাহিদার তুলনায় ধানের সরবরাহ পাচ্ছে না তারা। ধান বেশি দামে বিক্রি হওয়ায় উল্টো চালের দাম বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার শীর্ষ চাল ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ বলেন, ‘চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। সামনে  যে আউশ ধান আসবে তাতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। তখন কিছু মোটা চাল বাজারে আসবে। এতে চালের দাম কমার জন্য আবারও সামনের ইরি-বোরো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। আর সামগ্রিকভাবে আরও বাড়তে পারে দাম।’

তিনি বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ধানই আমরা অনেক বেশি দামে কিনছি। এতে চালের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। আর পর্যাপ্ত ধানও মিলছে না। ফলে সরকারকেও সেই দামে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল দিতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।’

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) তথ্যানুসারে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের গড় দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল। এর আগে ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতি কেজি চাল ছিল ৩৬ টাকা। আর বর্তমানে চালের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ।

এদিকে রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক বছরে মোটা চালের দর বেড়েছে ৪২ শতাংশ। মাঝারি ও চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৮ থেকে ৫৬ টাকায়।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত চাল আমদানির চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে তা দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও করছে অনেকে। তবে ঠিক সেই সময় বিশ্ব বাজারে চালের দাম বাড়া ও উৎপাদন কমার শঙ্কায় আমদানির পথও সুগম হচ্ছে না।

সর্বশেষ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, একমাত্র ভিয়েতনাম ছাড়া বিশ্বের মোটা চাল বিক্রয়কারী সব দেশে চালের দাম বেড়েছে। থাইল্যান্ডে পাঁচ দশমিক ১৭ শতাংশ, ভারতে এক দশমিক ৫৪ শতাংশ ও পাকিস্তানে প্রায় দুই শতাংশ বেড়েছে চালের দাম। আর গত বছরের তুলনায় এ বছর বিশ্বে চালের উৎপাদন ছয় লাখ টন কমবে। ফলে তিন বছর ধরে যেখানে চালের দর ছিল কমতির দিকে, এ বছর তা বাড়তে শুরু করেছে।

এ পরিস্থিতিতে গত বুধবার ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ৯০৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ভিয়েতনাম থেকে প্রতি মেট্রিক টন ৪৭০ মার্কিন ডলারে ৫০ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল আমদানি করা হবে। এতে খরচ হবে ১৯৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৪৩০ মার্কিন ডলার দরে দুই লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানি করা হবে। তাতে খরচ হবে ৭১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

তথ্যমতে, সরকারি গুদামে এখন মাত্র এক লাখ ৯১ হাজার টন চাল রয়েছে। গত বছরের একই সময়ে চালের মজুত ছিল প্রায় ছয় লাখ টন। এ ঘাটতি মজুত বাড়াতে শুরু হওয়া সরকারের নয় লাখ টন বোরো সংগ্রহের গতিও খুবই হতাশাজনক। গত বছর ১০ লাখ ২১ হাজার টনের বেশি বোরো সংগ্রহ করেছিলো সরকার। এবার এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার ৬২৫ টন। খাদ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত ১৬ হাজার চালকলের মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার চালকল সরকারকে চাল দিতে রাজি হয়েছে। সবার চাল এলেও তা দুই লাখ আট হাজার টনের বেশি হবে না।