সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানির বাজার রয়েছে বিশ্বের ১৩ দেশে। এ রাসায়নিক রপ্তানিতে বছরের আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ পণ্যটি রপ্তানি হয় ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়াসহ ১৩ দেশে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এক দুর্ঘটনার কারণে বড় শিপিং কোম্পানিগুলো সমুদ্রপথে এ পণ্য পরিবহনে রাজি না হওয়ায় চার মাস ধরে বন্ধ সমুদ্রপথে রপ্তানি কার্যক্রম। এতে হাতছাড়া হওয়ার পথে ৩০০ কোটি টাকার রপ্তানি বাজার।
রপ্তানিকারকরা জানান, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বেশি ব্যবহƒত হয় টেক্সটাইল শিল্পে। এছাড়া খাদ্যপণ্য ও ওষুধশিল্পে এ রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। টেক্সটাইল শিল্পের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে দেশীয় কারখানাগুলো। পাশাপাশি বাংলাদেশে তৈরি এ রাসায়নিকের রপ্তানির বাজার রয়েছে বিশ্বের ১৪ দেশে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশে ভারতে রপ্তানি হয়েছিল মোট রপ্তানির ৩১ শতাংশই। বাকি ৬৯ শতাংশ গেছে পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়া প্রভৃতি দেশে। গত অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় হয়েছিল ২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৬৫ লাখ ডলারের ১৮ হাজার টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর দিয়ে গেছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ডলারের দুই হাজার ৬৮৮ টন পণ্য। আর এ সময়ে স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৫২ লাখ ডলারের সমমূল্যের প্রায় ১৬ হাজার টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। যদিও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে এ পণ্যটি রপ্তানি হলেও সমুদ্রপথে এ পণ্য পরিবহনে রাজি হচ্ছে না বড় শিপিং কোম্পানিগুলো। এতে ভারত ছাড়া আরও ১৩ দেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি কার্যক্রমে সংকট তৈরি হয়েছে। মূলত চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে অগ্নিদুর্ঘটনার পর থেকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি নিয়ে চার মাস ধরে ভোগান্তিতে রয়েছেন পণ্যটির রপ্তানিকারকেরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর সমুদ্রপথে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শিপিং কোম্পানি ও রপ্তানিকারকদের নিয়ে বৈঠক করে। সে সময় আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে রাসায়নিকটির ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন রপ্তানিকারকেরা। এর পর থেকে সমুদ্রপথে রপ্তানিতে কনটেইনার দরকার। কিন্তু বড় শিপিং কোম্পানিগুলো কনটেইনারে এ পণ্য পরিবহনে এগিয়ে আসছে না, যদিও ছোট শিপিং কোম্পানিগুলো কিছু পণ্য রপ্তানি করছে। তা সংখ্যায় অনেক কম। অপরদিকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে এ পণ্য। এক্ষেত্রে কনটেইনারে পণ্য পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা করতে হয় না বলে সেখানে সমস্যা হচ্ছে না।
একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, হাইডোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হলোÑটিকে গ্রুপের সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড, মেঘনা গ্রুপের তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, স্মাট গ্রুপের আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এস আলম গ্রুপের ইনফিনিয়া কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, ঢাকার এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড কারখানা ও এমএইচ কেমিক্যাল। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ২০০ কনটেইনার রপ্তানি আদেশ আছে। কিন্তু শিপিং লাইনগুলো বুকিং না নেয়ার কারণে গত চার মাসে রপ্তানি কার্যত বন্ধ। তবে সড়কপথে ভারতে রপ্তানি হচ্ছে, যা মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশ। এভাবে হলে তো প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। অথচ এ খাতে উদ্যোক্তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। এ সংকট কাটাতে দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় একটি শিপিং লাইনের মহাব্যবস্থাপক শেয়ার বিজকে বলেন, বিএম ডিপোতে অগ্নিদুর্ঘটনার পর থেকে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড পরিবহনে বুকিং নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ। এ দুর্ঘটনা সবার মধ্যে একটি পেনিকড তৈরি করেছে। আর কয়েকটি কনটেইনারের কারণে একটি জাহাজের হাজার হাজার কনটেইনার বা জাহাজকে আমরা বিপদে ফেলতে পারি না। কারণ ডিজি কার্গো নীতিমালা অনুসরণ করে না এলে নেয়ার তো সুয়োগ নেই। এ কারণে সবাই এড়িয়ে চলছে। আর ছোট শিপিং কোম্পানিগুলোর সব দেশে পণ্য পরিবহন সেবা নেই। ফলে বড় শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন শুরু না করলে বাধা কাটবে না।
এ বিষয়ে কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সচিব রুহুল আমিন সিকদার শেয়ার বিজকে বলেন, জাহাজে তো সব কনটেইনার একসঙ্গে নেয়া হয়, তাহলে ডিপোতে কেন রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার রাখা যাবে না? এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। এটা তো কারখানা থেকে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিপোতে আনা হবে। তবে অন্যান্য কনটেইনার থেকে কত ফুট দূরে রাখতে হবে, কত দিন রাখা যাবে এবং জেরি ক্যানগুলো আন্তর্জাতিক বা ইউএন মান অনুসারে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সাধনা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে কয়েকজন উদ্যোক্তা এ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করছে। তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখানে সমন্বয় না থাকার কারণে রপ্তানিমুখী হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, ব্যাটারি ইত্যাদি, অর্থাৎ ডিজি কার্গো রপ্তানির নীতিমালা না থাকায় বছরের ৩০০ কোটি টাকা আয়ের এ খাতটি হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ অজানা। আর রাসায়নিক পদার্থ আলাদা ব্যবস্থাপনা করার মতো ডিপো নেই, আর হবেও না। কারণ যেখানে অন্যান্য পণ্যের এক হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়, সেখানে মাত্র ৫০ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে কি লাভবান হওয়া যাবে? বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
উল্লেখ্য, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বৈশ্বিক বাজার প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের। শীর্ষ রপ্তানিকারক বেলজিয়াম। বৈশ্বিক বাজারের প্রায় তিন শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে। আর বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে এ রাসায়নিক রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা করছে।