আতিকুর রহমান: সমাজে কালোটাকা এবং ছদ্মবেশী ও তোষামোদকারীদের ক্ষমতা ও শক্তির দাপটে সৎ, আর্দশবান ও আলোকিত মানুষগুলো নাস্তানাবুদ হয়ে বারবার পরাজিত হচ্ছে। সমাজে নীতি-নৈতিকতা আজ যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সৎ ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষের নীতি-আর্দশ ও বিবেকবোধ যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কালোটাকার কাছে সব নীতি ও আদর্শ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আজকে যার কাছে টাকা আছে, তার এই সোনার বাংলায় সব আছে। পদ-পদবি আরও কত কী? তারা চাইলে কি না মেলাতে পারে? এক্ষেত্রে তাদের সৎ, শিক্ষিত ও যোগ্য মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু টাকা ও অস্ত্রের শক্তি থাকলেই চলে। এই কালোটাকা ও শক্তির জোর যাদের আছে, তাদের আমরাই বড় বড় পদ-পদবির দিয়ে সম্মান দিই। তারা চাইলেই জীবনে তৃণমূলে রাজনীতি না করেও ভোটে দাঁড়ানোর জন্য যেকোনো দল থেকে অতি সহজেই নোমিনেশন পেয়ে যান। আর নির্বাচনে জয়ী হতে তারা কালোটাকা দিয়ে ভোট কিনে ক্যাডার দিয়ে ভোট কেন্দ্র দখল করেন এবং ভোট ডাকাতিও করেন। তারা শক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধিক দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, কালোবাজারি ও মাদকের ব্যবসা করে, দেশ ও জাতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে এবং অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করে, তা বিদেশে পাচারসহ সেখানে দ্বিতীয় হোম বানানো ও সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়া করানোসহ বিলাসী জীবন অতিবাহিত করেন। কেবল টাকা ও ক্ষমতার জোরে তাদের সব অনিয়ম নিয়মে পরিণত হচ্ছে। চাওয়ামাত্রই তারা সব নাগালেই পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগেÑতাদের এই অর্থের উৎস কী? তারা এমন কী আলাদিনের প্রদীপ পেলেনÑনীতিনির্ধারকরা একটু ভেবে দেখবেন কি?
সমাজে এই মুখোশধারীরাই মূলত সরকারের ভেতরে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাতারাতি হঠাৎ বড় বাবু বনে যান। তারাই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হন। মূলত তারা কালোবাজারি করে, সুদ খেয়ে, সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি বড় বাবু সেজে যান। অনেকে আবার শিল্পপতি ও বিদ্যানুরাগী হয়ে যান। বিদ্যানুরাগী সেজে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের নোংরা নেশায় মেতে ওঠেন। তারাই আবার অর্থ দিয়ে সম্মান কেনাসহ নানা পদ-পদবির বিশেষণে ভূষিত হন। এসব ছদ্মবেশীদের হাত থেকে যত দ্রুত সম্ভব দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দলের ভেতরে ও বাইরের ওইসব ছদ্মবেশী সুবিধাভোগীদের অপতৎপরতা নির্মূল করতে আপনি সদা সজাগ ও জাগ্রত থাকবেন, এমনটিই কাম্য। মূলত এরাই আপনার সরকারকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এদের কাছ থেকে সর্বদা সতর্ক থাকাটা অধিক শ্রেয় বলে মনে করি। দলে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়াটাই অধিক উত্তম বলে মনে করি।
সৎ ও সঠিক পথে থেকে কেউ এদেশে বিশাল অর্থের মালিক হয়েছেন, এমন নজির খুব কমই চোখে পড়ে। যারা মালিক হয়েছেন, তারা বাঁকা পথ অতিক্রম করেই অর্থের মালিক হয়েছেন। তাদের বড় বাবু, সমাজপতি বা দানবীর ভাবতে সত্যিই চরম ঘৃণা বোধ করি? যদিও কথায় আছে, ‘শকুন যত ওপরে উঠুক না কেন মন থাকে তার নিচের দিকে,’ কথাটি সত্য। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একজন কালোবাজারি যতই সমাজে নৈতিকতা দেখান না কেন, যতই সত্যের বাণী শোনান না কেন, সমাজের কাছে তিনি একজন কপট ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নন। তারা এসবে কর্ণপাত করেন না, কেননা তাদের নীতি-নৈতিকতা তলানিতে পৌঁছেছে। এককথায় তারা ভণ্ড।
যদিও বর্তমানে মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকরা সৎ থাকা ও সততাকে মানসিক সুস্থতার একটি মাপকাঠি হিসেবে মনে করেন। কিন্তু আমরা তা মেনে চলছিই বা কয়জন? মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, সততা মানুষকে বিচিত্র দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়। কথাটা চরম সত্য। কারণটা হলো মিথ্যা এবং অহমিকা বহু রকমের বিরক্তিকর পরিস্থিতির জš§ দেয়। আনন্দ ও সাফল্যের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এই মিথ্যা ও অসততা। নিজের ভালোর জন্য হলেও সৎ ও সততা আনয়ন করতে সচেষ্ট হওয়া জরুরি, এতে মনের প্রশান্তি মিলবে।
একটি জাতির উন্নয়নের মূল রয়েছে নৈতিক চরিত্র গঠন, শৃঙ্খলাবোধ ও আইন মেনে চলার প্রতি সংকল্পবদ্ধ হওয়া। কেননা নীতি-নৈতিকতার ওপর একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে ওঠে, জাতি সমৃদ্ধি লাভ করে। তাই দেশকে আগামীর এই তিমির অন্ধকার থেকে বাঁচাতে হলে প্রতিটি মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। ভালোত্ব গ্রহণ ও মন্দকে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা মনে ধারণ ও পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে জাপান ও সিংগাপুর এই দুটি দেশের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। ওই দেশগুলো কীভাবে এত দ্রুত উন্নত হয়েছে, প্রতিটি নাগরিক কীভাবে এত দেশপ্রেমিক হয়েছে, কীভাবে একটি শিশুকে নিজ পরিবার ও বিদ্যালয় থেকে নীতি-নৈতিকতা, সততা, আর্দশসহ দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, তা অনুসরণ ও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
দেশ গঠনে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি সেক্টর ও প্রতিষ্ঠানে সৎ লোকদের খুঁজে বের করে তাদের হাতে দায়িত্বভার দেয়া, কিংবা দায়িত্বে থাকলে তাদের মেয়াদ আরও বৃদ্ধি করে দেশ গড়ার কাজে তাদের সততাকে কাজে লাগানো। আর অসৎ লেবাসধারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
অন্যদিকে সৎ ও আর্দশবান জাতি তৈরিতে শিক্ষায় প্রাথমিক স্তর থেকে শিশুদের নৈতিক শিক্ষাগ্রহণের ওপর অধিক জোর দেয়া এবং শিশুকাল থেকে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষাদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুকালেই তাদের ভালোমন্দের ব্যবধান বোঝার শিক্ষাদানে সচেষ্ট হওয়া অধিক জরুরি।
বর্তমান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে মানুষের নৈতিক অধঃপতনের যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা দেখে আমরা শঙ্কিত। নৈতিক চরিত্র গঠন ও শৃঙ্খলাবোধ আনয়নে সততা শিক্ষার শুরুটা শিশুবয়স থেকেই হওয়া অধিক জরুরি। এই নৈতিকতার শিক্ষার সূচনা হওয়া দরকার পরিবার ও প্রাথমিক স্কুল থেকে। এই দুটোই হলো মূল উৎস, যেখান থেকে শিশু মৌলিক জিনিসগুলো গ্রহণ করবে এবং শিখবে। তথ্যমতে, ‘পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই জাপানিরা তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই তিনটি জিনিস শিক্ষা দেয় ন্যায়-অন্যায়, সামাজিকতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তা অনুসরণ করতে হবে। যেকোনো উপায়ে হোক আগামী প্রজš§কে আমাদের খাঁটি, সৎ ও আর্দশবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার সৎ ও মেধাবী আলোকিত মানুষ রয়েছেন। দ্রুত তাদের সততার মূল্য প্রদান করতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও সততার সম্মান দিতে হবে, যাতে অন্যজন উৎসাহিত হন। কেননা দেশের উন্নয়নে সৎ, আর্দশবান ও মেধাবী আলোকিত জনের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। সেদিকেই আমাদের অধিক দৃষ্টি দিতে হবে। তারাই পারবে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত এই দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করতে। এখন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও দেশের নীতিনির্ধারকরা যত দ্রুত ওই বিষয়টি উপলব্ধিতে আনবেন ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। কেননা আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সরকারের সময়কালে দেশে এসব সুখের পায়রারা সুযোগ বুঝে লেবাস পরিবর্তন করে অন্যের নীড়ে বাসা বাঁধবে। তাই সময় থাকতেই যত দ্রুত সম্ভব দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আরও গতিশীল করতে অসৎ মানুষকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে সৎ, খাঁটি, দেশপ্রেমিক ও নীতি-নৈতিকতার্ণ আলোকিত মানুষকে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের সুযোগ দিন।
সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা
বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি)