রাশেদুল ইসলাম : সমাজের প্রতিটি স্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। আজকের শিশুরাই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ এবং তাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ গঠন না হলে, সমাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যে সমাজে নৈতিকতার অভাব, সেখানে অপরাধ ও অস্থিরতা বাড়ে, আর সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই শিশুরা যেন ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠতে পারে, তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি, চট্টগ্রামের সানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাহাত হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যা শুধু আমাদের শোকেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তিনজন সহপাঠীর দ্বারা যে নিষ্ঠুরতার ঘটনাটি ঘটল, তা গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। যদি একজন শিশুর মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা সঠিকভাবে প্রদান করা না হয়, তাহলে সেই শিশু যেকোনো সময় এমনভাবে প্রভাবিত হতে পারে, যা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এই ঘটনাটি আমাদের সামনে এক জ্বলন্ত উদাহরণ, যে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা গড়ে তোলা কতটা জরুরি। নৈতিকতার অভাবে ঘটে এমন হত্যাকাণ্ড।
রাহাতের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া তিনজন শিশুর বয়স এবং মানসিকতা প্রায় একই। তবে তাদের আচরণে যে গভীর পাপবোধ এবং নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন ঘটেছে, তা আমাদের সামনে বড় প্রশ্ন রাখেÑ কোথায় ছিল তাদের মানবিকতা, যেখানে তারা এক জীবনকে বিপন্ন করেছে, এক পরিবারকে চিরতরে শোকসন্তপ্ত করেছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। শিশুর মধ্যে যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব, তা কিনা তাদের সঙ্গী বা সমাজের প্রভাব, বা তাদের পরিবারে শিক্ষা এবং মূল্যবোধের অভাব, তা নির্ধারণ করতে হবে। এই ঘটনার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়, নৈতিকতার সঠিক শিক্ষা না থাকলে, শিশুদের মধ্যে সমাজবিরোধী আচরণ গড়ে উঠতে পারে, যা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। পিতা-মাতার ভূমিকা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা এই ঘটনার পর, আমরা আবারও বুঝতে পারি, আমাদের শিশুদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয়েরই যথেষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে। একজন শিশু যখন তার পরিবারে এবং বিদ্যালয়ে সঠিক শিক্ষা পায়, তখন তার মধ্যে মানবিকতা, সহানুভূতি এবং ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জন্ম নেয়। কিন্তু যখন তার চারপাশে নৈতিকতার অভাব, সহিংসতা ও অপরাধের ছাপ দেখা যায়, তখন সে সহজেই ভুল পথে চলে যেতে পারে। তাই আমাদের সবার, বিশেষ করে পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো, তাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেয়া, যাতে তারা বুঝতে পারে অপরের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং সত্যের পথে চলা কীভাবে তাদের জীবনের সর্বোত্তম উদ্দেশ্য।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিকতা: বিশ্বের সব ধর্মেই মানুষের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্মে কোরআনে বারবার বলা হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, যেমন আমি তোমাদের ভালোবেসেছি’ (যোহর, ৩৫)। এটি কেবল মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং ধর্মীয় নীতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতির প্রতিফলন। খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি ধর্মও মানুষের মধ্যে সৎ, দায়িত্বশীল এবং সহিষ্ণু হতে উৎসাহিত করে। যদি প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতির দিকে নজর দিই, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং মানবিকতা গড়ে তোলা একমাত্র উপায়, যাতে পৃথিবী এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের ভূমিকা: শুধু পরিবার বা ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজও শিশুদের নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধে গড়ে তুলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু পাঠ্যবই পড়ানো নয়, বরং শিশুদের মধ্যে সত্য, ন্যায়, ভালোবাসা এবং সহানুভূতির মতো গুণাবলির সৃষ্টি করা। এ ছাড়া সামাজিক সংগঠনগুলো, মিডিয়া এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়বদ্ধতা রয়েছে, যাতে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তারা ভবিষ্যতে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে। বহু ধরনের মানসিক প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ শিক্ষার গুরুত্ব শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি তাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ এবং বৃহত্তর সমাজে তাদের ভূমিকা গঠনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। শিশুদের মধ্যে এমন শুদ্ধ ও সঠিক মানসিকতা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তারা সমাজে শান্তি, সহিষ্ণুতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। এই জন্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি শিক্ষাব্যবস্থা এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের কাছে নৈতিকতা ও মানবিকতার মূলনীতি পৌঁছানো খুবই জরুরি। সর্বোপরি, নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত সমাজ গঠন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা নিজেদের সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি। যেমন, চট্টগ্রামের ছাত্র অধিকার পরিষদ মহানগর সম্প্রতি রাহাত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে। তবে এর পাশাপাশি, আমাদের দায়িত্ব হলো, শিশুদের মধ্যে এসব মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির মতো গুণাবলির প্রতিস্থাপন করা।
তাদের যদি সঠিক নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়, তবে তারা কখনও অপরাধের পথে যাবে না। তাদের মধ্যে মানবিকতার বীজ রোপণ করতে হবে, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করতে পারে। একটি সমাজ যখন শিশুদের নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, তখন সেখানকার ভবিষ্যৎ প্রজš§ নিরাপদ, সৎ এবং মানবিকতার দিকে আগাবে। সমাজের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজে পরিণত হতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।