জিনাত রহমান: আমাদের ছোট দেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। জনসংখ্যার আধিক্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সীমিত কর্মসংস্থানের সুযোগ, পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যের মান এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত পর্যায়ে না পৌঁছানো ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের এ বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের জীবন-জীবিকা এগিয়ে নিচ্ছে। এমনি এক পরিবেশে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অপুষ্টি আরও একটি প্রধান অন্তরায়।
বাংলাদেশের পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টি একটি শিশুর মেধাসহ সার্বিক বিকাশের পথে অন্তরায়। সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সামর্থ্য, পুষ্টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকা এ সবকিছুই অপুষ্টিজনিত সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার গর্ভকালীন মায়ের অপুষ্টি থেকে গর্ভের শিশুটি অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। কাজেই পুষ্টির বিষয়টি পারিবারিক প্রেক্ষিত থেকেই বিবেচনায় নিতে হবে। আর ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সব শ্রেণির মানুষকেই তার সামর্থ্যরে মধ্যে পুষ্টিকর খাবারের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
গর্ভাবস্থায় একজন মা ও সন্তান অবিচ্ছিন্ন সত্তায় অবস্থান করে। এ সময় মায়ের খাবার ও পুষ্টি সন্তানের মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখে। ফলে সন্তান জন্মদানের জন্য মায়ের সার্বিক স্বাস্থ্য যেমন ঠিক রাখতে হবে, তেমনি সন্তানের স্বাস্থ্যের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ একজন সুস্থ মা’ই সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় একজন মা পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে, সে অপুষ্ট সন্তান প্রসব করবে। চিকিৎসকদের মতে, পাঁচ দশমিক পাঁচ পাউন্ডের কম ওজনের সন্তান কাক্সিক্ষত ওজনের সন্তানের চেয়ে বেশি সমস্যা এবং রোগপ্রবণ হয়ে থাকে। কাজেই গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মায়ের পুষ্টির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
শিশুর পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য তালিকায় সামর্থ্য অনুযায়ী শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে। ইদানীং বেশিরভাগ শিশুদের মধ্যে খাবারের প্রতি অনীহা দেখা যায়। তাদের খাবারে পরিবর্তন আনতে হবে। সেসব শিশুর ওজন বেশি ও বেড়ে ওঠার গতি ভালো, তার সঙ্গে হালকা-পাতলা কম ওজনের শিশুর খাবারের ভিন্নতা লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে শিশুর পুষ্টি, পরিপূর্ণ বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য পুষ্টিকর খাবার কতটা প্রয়োজনীয়।
লৌহ জাতীয় খাবার শিশুর শারীরিক গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। শিশুর বৃদ্ধির বিকাশে লৌহ জাতীয় খাবারের ভূমিকা অপরিসীম। রক্তস্বল্পতা, শিশুদের মনোযোগ ক্ষমতা, খিটখিটে মেজাজ, অবসন্নতা ইত্যাদি সমস্যা লৌহ জাতীয় খাদ্য ঘাটতির কারণে দেখা দিতে পারে। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকে পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত লৌহ সমৃদ্ধ উপাদান জন্মগতভাবেই ধারণ করে। এ সময়ে মায়ের দুধই একমাত্র খাবার। আর মায়ের দুধে সব ধরনের পুষ্টি বিদ্যমান। কিন্তু ছয় মাস বয়সের পর থেকে শিশুকে লৌহ সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার, ফলমূল, সবজি, মাংস, মাছ, ডিম ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে শিশুদের খাওয়ালে এনিমিয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
ক্যালসিয়াম বা খনিজ উপাদান শিশুদের হাড় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই মজবুত হাড় গঠনে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে। এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুর অন্তত ৫০০ গ্রাম ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিনের খাদ্যে সংযুক্ত করা আবশ্যক। দুধ, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, কমলা, মিষ্টিআলু, কাঁচাকলা, শিম, শিমের বিচি, ডিমের কুসুম সবজি, মাছ, বাদাম ইত্যাদি ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার, যা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অন্যতম অনুষঙ্গ।
এছাড়া ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ খাবার শিশুদের বিভিন্ন প্রকার রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়। তাই শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন ‘এ’ দেহের কোষ বিভাজন এবং বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। হাড় ও দাঁত শক্ত এবং মজবুত হতে সাহায্য করে, ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। মাছ, কলিজা, ডিমের কুসুম, দুগ্ধজাত খাবার, হলুদ ফলমূল, ও শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ আছে। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ভিটামিন ‘বি’ অপরিহার্য। ভিটামিন ‘বি’ বিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। মাংস, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, সামুদ্রিক মাছ, ডিম এবং শর্করা জাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘বি’ থাকে। শিশুদের জন্য তাই ভিটামিন ‘বি’ সমৃদ্ধ খাবার অত্যাবশ্যক। ভিটামিন ‘সি’ শরীর গঠনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর কাজ হলো রক্ত কণিকার দেয়াল শক্তিশালী করা, ব্যথা প্রশমন করা, লৌহ কণিকা শোষণ করা এবং রক্তের চর্বি বা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা। ভিটামিন ‘সি’ রসালো ফল, ফলের রস বা জুস, জাম, কাগজিলেবু, জলপাই, আমলকী, কামরাঙা, জামবুরা ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজিতে পাওয়া যায়। শিশুদের খাবারে ভিটামিন ‘সি’ সংযুক্ত করলে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ভিটামিন ‘ডি’ শিশুদের হাড় ও দাঁত শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাখন, ডিমের কুসুম, ছোট মাছ বা কাঁটা জাতীয় মাছ থেকে প্রচুর ভিটামিন ‘ডি’ পাওয়া যেতে পারে। শিশুদের খাবার প্রস্তুত করার সময় এগুলো সংযুক্ত করলে সুষম খাদ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া ভিটামিন ‘ই’ এবং ভিটামিন ‘কে’ মাংসপেশি শক্তিশালী করতে, লৌহ কণিকার ভারসাম্য রক্ষার জন্য এবং রক্তজমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজন। ডিমের কুসুম, সবজি, বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার, সবুজ জাতীয় শাকসবজি এবং মাছের তেল থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘ই’ এবং ভিটামিন ‘কে’ পাওয়া যাবে। এছাড়া জিংক হজম প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রদাহ প্রতিরোধ, ডায়রিয়া প্রতিরোধ, চামড়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে থাকে। বিভিন্ন প্রকার বীজ জাতীয় খাবার, বাদাম, নারকেল, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদিতে জিংক পাওয়া যায়।
শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সব ধরনের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনযুক্ত খাবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সুষম খাবার মানে বিদেশি দামি খাবার নয়, বরং সব উপাদান সমৃদ্ধ খাবারই সুষম খাবার। সুষম খাবার পেতে দামি কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই, দেশীয় সব খাবারেই এসব উপাদান রয়েছে। আমাদের দেশীয় মাছ, মাংস, ফল, শাকসবজিতে অনেক ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন আছে, যা অনেক দামি খাবারেও নেই। মলা-ঢেলা মাছ, বড়ই, আমলকী, জামবুরা, কাগজিলেবু, কামরাঙ্গা, পুঁইশাক, লালশাক, কচুশাক, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা ইত্যাদি যেমন দামে সস্তা, তেমনি পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব খাবার হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে এসব খাবার যথেষ্ট উপকারী। তাই খাবারের গুণাগুণ মেনে যদি সুষম খাবার আমরা শিশুদের খাওয়াতে পারি, তাহলে আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে এবং বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত আবশ্যক। কাজেই একটু সচেতন হলেই শিশুর জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাবার নিশ্চিত হবে। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§ স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিভার অধিকারী হবে, দেশ গঠনে সফল অবদান রাখতে পারবে।
পিআইডি নিবন্ধ