নাঈমা কেয়া: জেলে বন্দি না থাকলেও করোনার কারণে ঘরে বন্দি শিশুরা। করোনা সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে। গ্রাস করেছে পুরো পৃথিবীকে। যুবক, বৃদ্ধের সঙ্গে শিশুরাও এর ছোবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
নাজমা খাতুন ঢাকায় থাকেন, তিনি একটি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তার দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী এবং ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। করোনার কারণে দুজনেরই স্কুল ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ। মেয়েটা মোটামুটি পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও ছেলেটার পড়াশোনা একদম বন্ধ বললেই চলে। মেয়েটা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থেকে পড়াশোনা কিছুটা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ছেলেটাকে মোটেই পড়াশোনায় বসানো যাচ্ছে না। মেয়েটা তার মাকে সমীহ করে কিন্তু ছেলেটা এত দুষ্টু যে, সে তার মায়ের কথায় কর্ণপাত করে না। ছেলেটার সময় কাটে কম্পিউটারে, না হয় টেলিভিশনে কার্টুন দেখে। তার কাছ থেকে টিভির রিমোর্ট নেওয়া কষ্টকর। বাসায় যখন বিদ্যুৎ থাকে না তখন জানালা দিয়ে কিংবা বারান্দায় গিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল।
সরকারি চাকরিজীবী বেনজির ইসলাম ঢাকাতেই থাকেন। তার দুই বছর বয়সের একটা মেয়ে আছে। তার মেয়ের একটাই আবদার বাবা বাইরে নিয়ে চল। সে যখন বারান্দা দিয়ে দেখে যে, বাইরে অনেক ছেলেমেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন বাবার সঙ্গে চিৎকার করে বলে যে, বাবা তাকে ইচ্ছে করেই বাইরে নিয়ে যাচ্ছে না। সে কথা বললে শুনে না, ঠিকমতো খাবার খেতে চায় না; শুধু বিরক্ত করে। কোনো খেলনাই তার পছন্দ নয়।
শিশুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হাতে দেওয়া হচ্ছে পাঠ্যবই, যা চলছে রাত পর্যন্ত, মাঝে খাবার ও গোছলের বিরতি ছাড়া। এমন পরিবেশে এক একটি শিশুর ওপর বয়ে চলছে ঝড়। গ্রামের শিশুরা বাড়ির আঙিনায় বের হতে পারলেও শহুরে শিশুদের দিন কাটে পাঠ্যবই আর চার দেয়ালের ভেতর। সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশে একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারিদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত।
শিশুর মানসিক বিকাশে শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাদের আঘাত করে বা জোড় করে কোনো কিছু শেখানো যাবে না। তাদের আলাপ-আলোচনায় উৎসাহিত করতে হবে। তাদের বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে। ধৈর্য সহকারে তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তাদের খেলাধুলা এবং শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে। কোনো সমস্যা সমাধানে তাদের সহায়তা করতে হবে। তাদের আবেগ অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের আচার-আচরণের পরিবর্তনের দিকে নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি মানসিক বিকাশে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শিশুর পাঠ্যবই পড়াশোনায় তখনই মনোযোগ আসবে যখন তার মস্তিষ্কে কোনো ধরনের চাপ থাকবে না। এ রকম আনন্দময় পরিবেশ তৈরি কিংবা চাপ কমানোর উত্তম সময় হলো ঘরের বাইরের পরিবেশ কিংবা খেলাধুলা, যা এখন এ করোনা পরিস্থিতিতে সম্ভব হয়ে উঠছে না। শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়তে দেখা যাচ্ছে, যা শিশুর মানসিক বিকাশে অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিবেশে শিশুকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিশুর বিনোদন নিশ্চিত করতে হবে। বিনোদনের জন্য ঘরের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শিশুর হাতে তুলে দিতে হবে সহায়ক কিছু বই, যা তাকে বর্ধিত জ্ঞানের পাশাপাশি দেবে অনেকখানি আনন্দ। দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যদি ছবি আঁকার সুযোগ পায় তাহলে তারা মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভিনব চিন্তার মাধ্যমে শিশু যখন শিল্পচর্চার সুযোগ পায় তখন তার সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। সে অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে, যা তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শেখায় এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে সে তখন সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
করোনার কারণে বেশিরভাগ মানুষই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন। এর প্রভাবে শিশুদের স্কুলও বন্ধ। অন্যদিকে আবার অনেক মা-বাবাকে বাড়িতে বসে কাজ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্যারেন্টিং বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ সময়টা মা-বাবা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারেনÑতা নিয়ে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
শিশুরা এর মধ্যে করোনার কথা জেনেছে। তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে। গোপন করা বা নীরব থাকা যাবে না। তাদের সত্যিটা জানা জরুরি। তবে সে যতটা বুঝতে পারবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে তার সঙ্গে ততটাই কথা বলুন। যদি বিষয়টি নিয়ে সে আতঙ্কগ্রস্ত থাকে তাহলে তার মনোভাব শেয়ারের সুযোগ দিন। স্কুল বন্ধ থাকার এ সময় সন্তানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে পারেন। তাদের সঙ্গে মজা করুন। তাদের সময় দিন। এতে শিশুরা নিজেদের সুরক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে। আমরা প্রায়ই শিশুদের বলি এটা করো না, ওটা করো না। কিন্তু তাদের প্রশংসা করলে, ইতিবাচকভাবে আদেশ দিলে মন ভালো থাকবে। তারা ভালো কাজে উৎসাহী হবে। কভিড-১৯ এর প্রভাবে সবারই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। শিশুদের জন্য এটা আরও খারাপ হয়েছে। তাদের পড়াশোনা, খেলাধুলা বা অন্য কাজের জন্য আলাদা রুটিন তৈরি করে দিন। ছবি আঁকতে দিন। ঘরের কাজে উৎসাহিত করুন। শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা শেখান। হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা শেখান। লকডাউনের কারণে অনেক শিশু, টিনএজার দিনের অনেকটা সময় অনলাইনে কাটাচ্ছে। তারা অনলাইনে কি দেখছে, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বাড়িতে কীভাবে ডিভাইস ফ্রি পরিবেশ তৈরি করা যায় সেই চেষ্টা করুন। আর সে কারণেই নিজের এবং শিশুদের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন। বেশি চাপ বোধ করলে কাজে বিরতি নিন। নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করুন। পরিবারের মধ্যে যদি একাত্মতা থাকে, শিশুরা এ সময় নিজেদের নিরাপদ বোধ করবে। পরস্পরের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব শান্তিপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ বজায় রাখবে। পারিবারিক পরিবেশ খারাপ হলে সেটা শিশুদের ওপরও প্রভাব ফেলে। তাই যতটা সম্ভব বাড়িতে শান্তির পরিবেশ বজায় রাখুন।
শিশুর মানসিক পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, এ সময়ে শিশুদের সঙ্গে গঠনমূলক গল্প বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন বা তাদের সঙ্গে ঘরোয়া খেলাধুলা যেমন কেরাম, লুডু, দাবা প্রভৃতি খেলতে পারেন। ফলে তাদের টিভিতে কার্টুন বা কম্পিউটার দেখা থেকে বিরত রাখতে পারবেন। শিশুদের এখন অলস মস্তিষ্ক, আর এ সময় তারা তাদের পাঠ্যবই পড়তে বেশি আগ্রহ দেখাবেন না। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও পুষ্টি দরকার হয়। মস্তিষ্কের পুষ্টি হলো ভালো চিন্তা।’ সারা দিন ফেসবুক-ইউটিউবে থাকলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ভালো চিন্তা বাদ দিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ভর করে। আচরণ পাল্টে যায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে।
ঢাকার ডেল্টা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক মনে করেন, এ সময় শিশুদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে, তাদের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। গল্পের ছলে কথা বলতে হবে কিন্তু কোনো বিরক্ত হওয়া যাবে না। বিরক্ত হলেই সে মনে করবে যে, কেউ তাকে ভালোবাসে না।
সরকার করোনাকালে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া চালু রাখার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলোÑঅনলাইন ক্লাস চালুর ব্যবস্থা। সরকার ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বনামধন্য কিছু শিক্ষকের দ্বারা সংসদ টিভির মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা অনেক উপকৃত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে।
শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ আবেগগত ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের জন্য শিশুর উপযোগী একটি সুষ্ঠু, সুন্দর, নির্মল ও প্রাণবন্ত পরিবেশ দরকার। খেলাধুলা শুধু শারীরিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা যেমন মজা পায়, তেমনি এর মাধ্যমে এদের মস্তিষ্ক বিকাশ ঘটে। শিশুর সার্বিক বিকাশের ওপর নির্ভর করে তাদের পরবর্তী জীবনের সুখ ও স্বাভাবিকতা। বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ এর কবল থেকে আমরা বের হয়ে আসব ইনশাল্লাহ। সেই দিন আর দূরে নয়। আর তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও মা-বাবাকে কিছুটা সময় বের করে শিশুর সান্নিধ্যে কাটাতে হবেÑএ প্রত্যাশাই হোক আমাদের সবার।
পিআইডি নিবন্ধ