শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশের দায়িত্ব নিতে হবে

রিয়াজুল হক

সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাসে একদিন গণিত স্যার মজিবর রহমান শেখ বলেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাত জেগে পড়ার জন্য হ্যারিকেনের তেল চোখে লাগিয়ে নিতেন। এতে তার চোখে জ্বালা করতো, তবে ঘুম কেটে যেতো। ফলে রাত জেগে পড়তে কষ্ট হতো না। মাদাম কুরি দুবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। অর্থের অভাবে হোটেলে তিনি থালা-বাসন পরিষ্কার করার কাজও করেছেন। কিন্তু লেখাপড়া থামিয়ে দেননি। তারা কেউ আজ বেঁচে নেই। কিন্তু সবাই তাদের মনে রেখেছে। সবশেষে স্যার বলেছিলেন, তোমাদের এ সময় খুব মূল্যবান। এখন যদি সময় নষ্ট করো, তবে জীবনের বাকি সময় আফসোস করে কাটাতে হবে। আর লেখাপড়া করলে করার মতো করতে হবে। কোনো কিছু অল্প অল্প ভালো নয়। লেখাপড়া খুব সহজ একটা বিষয়। বইকে ভালোবাসতে হবে। আর তোমাদের বাবা-মায়ের কাছে শুনবে তারা তোমাদের কাছে কী চান? তোমাদের নিয়ে তাদের প্রত্যাশা অনেক। তোমাদের জন্যই তাদের সব পরিশ্রম। তাদের বৃদ্ধ বয়সে তোমরাই অবলম্বন হবে। কিন্তু সেজন্য নিজেদের সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। তারা যেভাবে চান, সেভাবে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করো। কারণ বাবা-মা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। স্যারের সে কথাগুলো যেন এখনও কানে বাজে।

ব্যতিক্রম কোনো ঘটনার বর্ণনায় যাবো না। লেখাপড়াকে ছাত্রজীবনের তপস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। লেখাপড়াই হবে ছাত্রদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। ছাত্রজীবন আদর্শ ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ার সময়। কিন্তু অনেক কিছুর পরিবর্তনের সঙ্গে আজ ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্যও যেন পরিবর্তন হতে চলেছে। ছাত্রদের হাতে এখন অনেক কাজ। লেখাপড়া যেন গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে!

যে লেখাপড়াকে তপস্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে, সে লেখাপড়া থেকে আজ শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। সমস্যাটি শুধু আমাদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, খোদ আমেরিকাতেও বিদ্যমান। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় এক হাজার ৩০০ অভিভাবক ও সন্তানদের ওপর কমনসেন্স মিডিয়া কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৫৯ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন তাদের টিনএজ সন্তান মোবাইল ফোনে আসক্ত এবং ৫০ শতাংশ টিনএজ সন্তান মোবাইল ফোনে আসক্তির কথা স্বীকার করে নেয়। মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত ভিডিও গেম, ইন্টারনেটে আসক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হচ্ছে। এই আসক্তি এখনও কোনো স্বীকৃত রোগ নয়, যে কারণে পুনর্বাসনের জন্য ইন্স্যুরেন্স কাভারেজও পাওয়া যাচ্ছে না। এই হচ্ছে বিশ্বের শক্তিধর দেশের কিছু শিক্ষার্থীর অবস্থা।

আমরা শিক্ষার মান ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যে লেখাপড়া থেকে দূরে সরে চলে যাচ্ছে, সে কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি। সারা রাত মোবাইল ফোনে চ্যাটিং করে সকালে ক্লাসে গেলে স্যারের কোনো কথাই মাথায় ঢোকার কথা নয়। অভিভাবকরাও সন্তানকে দামি উপহার কিনে দেওয়ার মাঝে সাফল্য খুঁজে বেড়ান।

২০-২৫ বছর আগেও মাধ্যমিকে ৪৫-৫০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করতো। এখন ৯০ শতাংশের বেশি মাধ্যমিকে পাস করছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে শোনা যায়Ñএখন পরীক্ষা দিলেই তো পাস! তবে এত কষ্ট করে পড়ার দরকার কী? কথাগুলো না মেনেও উপায় নেই। সার্টিফিকেট অর্জনই যদি শিক্ষার্থীর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হবে, তবে রাত জেগে পড়ার দরকার কী? হাতের কাছে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি। আজকের স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। ইন্টারনেট ছাড়া এসব মোবাইল আবার ব্যবহার-অনুপযোগী। কী নেই সেখানে? তবে ভালো কিছু গ্রহণ করার মতো বিচার-বিবেচনা আদৌ কী এ বয়সী ছেলেমেয়েদের রয়েছে? টেলিফোন-সংস্কৃতি আমাদের সমাজ থেকে এক রকম উঠেই গেছে। থাকলে হয়তো সমাজের জন্য কিছুটা ভালোই হতো। শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ ও আকর্ষণ দুটোই অনেক বেশি থাকে। তাই মোবাইল ব্যবহারে অনেককে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। অনেক বাবা-মা দুজনই বাইরে কর্মরত বিধায় সারাক্ষণ সন্তানের খোঁজ-খবর রাখা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সন্তানকে মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার কথা ভাবেন তারা। তবে মোবাইল ফোন দেওয়ার আগে তার বয়স-উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। সন্তান যা চাইবে, সেটা তার জন্য ক্ষতিকর কি নাÑতা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। কারণ মোবাইল ফোন শিশু-কিশোরদের জন্য মাদকদ্রব্যের মতো হয়ে গেছে, যা পাওয়ার জন্য তারা আবদার করে এবং পাওয়ার পর লেখাপড়া বাদ দিয়ে ওই যন্ত্রটি নিয়েই পড়ে থাকে। নেশায় আসক্তরা যেমন নেশার বস্তু না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ে, এই শ্রেণির রোগীরাও মোবাইল ব্যবহার করতে না পারলে বিষণœতা ও শারীরিক অস্থিরতায় ভোগে। ই-মেইল আসার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও এক-দুই মিনিট পরপর জি-মেইল, ইয়াহু কিংবা হট-মেইল চেক করতে থাকে। এসব কিন্তু ভালো কোনো লক্ষণ নয়।

বর্তমান সমাজ জীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় ছাত্রসমাজকেই বেশি প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতায়। তাদের সামনে কোনো আদর্শ তুলে ধরা হয় না। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। বড়রা শিক্ষা বলতে বোঝেন পরীক্ষা ও সার্টিফিকেট। জীবনে উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষায় ছাত্ররা পায় না মহত্তর কোনো জীবনবোধ।

আজকাল ছাত্ররা ইভটিজিং, গ্যাংস্টার তৈরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী মাদকের মাধ্যমে তরুণদের ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ঠিলে দিচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবে ছাত্রদের একটি অংশ আজ বখাটেপনায় ধাবিত হচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধ জীবনে অনুসরণযোগ্যÑযা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচিস্নিগ্ধ- এমনসব বিষয়ে শিক্ষাদান আজ যেন অনুপস্থিত! এসব শিক্ষায় জড়িয়ে আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শ্রম, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়াসহ বিশেষ কতগুলো গুণ। এসব শিক্ষা মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক-সামাজিক উৎকর্ষের জন্য এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিতের জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এ নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের সঠিক সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন।

ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে স্কুলজীবনে যিনি গণিতে শূন্য পেয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তিনিই গণিতে পিএইচডি করেছেন। অনেক বাধা আসতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য থাকতে হবে অটুট। প্রেরণার নাম হতে পারে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। জন্মের ৯ বছরের মাথায় মাকে হারানো, ১৯ বছর বয়সে বোনকে হারানো, ২২ বছর বয়সে ব্যবসায় মার খাওয়া, ২৩ বছর বয়সে চাকরি হারানো এবং আইন স্কুলে ভর্তি না হতে পারা, ২৪ বছর বয়সে দেউলিয়া হওয়া, পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ থেকে ফিরে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়া, বিয়ের পূর্বমুহূর্তে ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যু ও নার্ভাস ব্রেকডাউনে ছয় মাস শয্যাশায়ী থাকা, সন্তানের মৃত্যু, ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যাওয়া, ৪৭ বছর বয়সে মাত্র ১০০ ভোটের ব্যবধানে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে হেরে যাওয়া, ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর নির্বাচনে হেরে যাওয়াসহ জীবনের ৪৯টি বছর প্রায় প্রতিটি কাজে ব্যর্থতার পর ৫১ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। আগের কোনো ব্যর্থতাই তখন আর ব্যর্থতা থাকলো না। প্রত্যেকেরই উচিত ছাত্রজীবনে নিজের লক্ষ্য ঠিক করে এগিয়ে যাওয়া। তবেই উদ্দেশ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে।

আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেশ চালাবে তারা। তাই সবার আগে তাদের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের সামনে আজ অনেক আগ্রাসনের হাতছানি। নিষিদ্ধ জিনিসে বেশি আকর্ষণ থাকে। তথ্য-প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূণ। এ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার প্রতিও আগ্রহ তৈরি করে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার বিকল্প যে কিছু নেই- এটা তাদের বোঝাতে হবে। বিষয়টি আমলে না নিলে ভবিষ্যতে এ সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করবে, যা জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। উন্নয়নের সিঁড়ি ধরে শিক্ষার্থীরা আরও এগিয়ে যাবেÑএ প্রত্যাশা আমাদের।

 

উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

riazul.haque02@gmail.com