আজহার মাহমুদ: ধর্ষণ। খুব সহজ একটা শব্দ মনে হতেই পারে। অকপটে মুখ থেকে বের করা যায়। রোজ যে শব্দটা শুনতে অভ্যস্ত এদেশের মানুষ। আজ এ পত্রিকায়, কাল ও পত্রিকায়। ধর্ষণ শব্দটি দেখছি আর দেখছি। কিন্তু ধর্ষণ শব্দটির আগে যখন শিশু শব্দটি যোগ হতে দেখি, তখন বুকের পাঁজরে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা অনুভব হয়। জানি না রোগটা কি বিধাতা শুধু আমায় দিয়েছেন, নাকি সবারই এমন নোংরা কাজ দেখে আমার মতো ব্যথা অনুভব হয়। কিন্তু এ ব্যথাটা কতটা মারাত্মক ও ভয়াবহ সেটা নিজের পরিবার এবং প্রিয়জনের সঙ্গে না ঘটলে হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন না। তবে সৃষ্টিকর্তা যেন এমন কষ্ট আর কাউকে না দেন সেটাই কামনা করি।
পত্রিকার সূত্রে জানতে পারলাম, গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর ডেমরায় বাসার খাটের নিচ থেকে শিশু দুটির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার নাম করে শিশু দুটিকে বাসায় ডেকে ধর্ষণ করতে চেয়েছে কিছু পশু। ব্যর্থ হয়ে শিশু দুটির একজনকে গলা টিপে এবং আরেকজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। একইদিনে রাজধানীর তুরাগ এলাকায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার চেষ্টা করে এক যুবক। এর একদিন আগে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাবতলা গ্রামে আট বছর বয়সী এক শিশু ‘ধর্ষণের’ শিকার হয়। পৃথক আরও একটি ঘটনা ঘটেছে ৫ জানুয়ারি। রাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় দুই বছর ১০ দিনের একটি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ ৫, ৬ এবং ৭ তারিখ এই তিন দিনে চারজন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যা অতি নিকট সময়ে ঘটে গেল। ভাবতে অবাক লাগে এত নিকৃষ্ট কাজ আমার দেশে নিয়মিতভাবে হচ্ছে, যার প্রতিরোধ কেউ করছে না।
এ যেন এক নষ্টামি আর ভণ্ডামির লাগামহীন লীলাখেলা। দিনের পর দিন এভাবে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের সঙ্গে অন্যায় চলছে আর চলছে। আর সমাজের বিবেকবান মানুষ এটা দেখে নিন্দা জানিয়ে নাক ঢেকে ঘুমাতে যায়। বাস্তবে না আছে আমাদের ভেতর দয়া, না আছে ভালোবাসা। যদি থাকত তাহলে এমন নিষ্ঠুর ঘটনাগুলোর পরেও আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারতাম না। এ বিষয়ে সমাজের এবং রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত। অথচ এর কিছুই দেখছি না। আমরা পত্রিকায় এবং টেলিভিশনের খবরে যা দেখি তা হয়তো সবাই জানি, কিন্তু যা খবরের কাগজে উঠে না তা জানতেও পারি না। তার মানে এই না যে, পত্রিকায় খবরেই ধর্ষণের ঘটনা সীমাবদ্ধ। রোজ দেশের কোনো না কোনো স্থানে চলছে এ নোংরামি, যা হয়তো আমার আর আপনার অজানা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে দেশে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬ জন শিশু। অর্থাৎ ওই এক বছরে শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ। অন্যদিকে শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে সারা দেশে দুই হাজার ৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরও ৬৩৯ জন শিশু।
এছাড়া গত চার বছরে সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ জন শিশুকে। আর ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন শিশু। শুধু তাই নয়, গত তিন বছরে সারা দেশে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩১ শিশু। যার মধ্যে ১১২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংস্থাটির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৩ জন শিশু। যার মধ্যে ২৬ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৯ শিশু। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৮ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে ছয় শিশু। এই ১১ মাসে ৯৩ জন শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়।
পরিসংখ্যান দেখে এটা অন্তত বুঝা যায়, এই নোংরামি কমবে না। আমাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে ১৪৭ জন বেড়ে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে ১৫৫ বেড়ে ৭৪৪ জন শিশু ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাহলে এটা থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? প্রতি বছর এটা বৃদ্ধি পাবে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে যৌন নিপীড়ন ছাড়া শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে দুই হাজার ৩২২ নিষ্পাপ শিশু। যাদের বয়স দুই থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। প্রতি মাসে গড়ে ৬৪ জন শিশু ধর্ষণ হয় বাংলাদেশে। আর দৈনিক গড়ে দুজন করে শিশু ধর্ষণ হচ্ছে।
আইনত ১৮ বছরের কম বয়সের একজনকে যদি প্রলুব্ধ করে বা তার সঙ্গে সমঝোতায়ও যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, তারপরও সেটা ধর্ষণ। গ্রামগঞ্জে আজকাল ‘ধর্ষণ’ই যেন বিনোদনের উপাদানে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে নিকটাত্মীয় কর্তৃকও ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে পরিবারে, নিকটাত্মীয় দ্বারা। এসব ঘটনার অনেক কিছুই প্রকাশ পায় না। একইভাবে শিক্ষিত মহল, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যেও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, যা প্রকাশ পায় না।
অনেক আগে থেকেই এ ধরনের মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়ে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনায় প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় রয়েছে পর্নোগ্রাফি। তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেটসহ মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদিতে পর্নোছবি দেখার মাধ্যমে এই মানসিকতা তৈরি হয় অপরাধীর। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষ যখন পর্নোগ্রাফি দেখে, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে হরমোন নিঃসরণ হয়। যার মাধ্যমে ওই ব্যক্তি যৌনাচারে উৎসাহিত হয়। এ ধরনের মানুষ তখন যৌন আচরণ করার জন্য পশুর মতো হয়ে ওঠে। শুধু পর্নোগ্রাফি নয়, মাদকও আরেক নিয়ামক। এমনও অনেক মাদক রয়েছে, যা সেবন করলে সেবীকে যৌনতায় প্রবৃত্ত করে। কিছু কিছু নাটক, চলচ্চিত্রসহ বিশ্ব সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ধর্ষণে উৎসাহিত করে। এসব উপাদান বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে খুঁচে খুঁচে নষ্ট করছে। মেয়েরা ভোগের বস্তু এমন ধারণা তাদের মধ্যে প্রোথিত করছে। জাতীয়ভাবে আমাদের নিজস্ব পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা অত্যন্ত মজবুত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ব সংস্কৃতির যে সুনামি চলছে, তা আমাদের পারিবারিক-সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিতাবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তার। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকাণ্ডের অভাব ইত্যাদি। এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আমরা শুনি, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়।
ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে হবে আমাদের। পাশাপাশি আমাদের বহু ঐতিহ্যের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলেই আমরা এই ভয়াবহতা এবং অমানবিকতা থেকে রক্ষা পেতে পারি।
কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার
azharmahmud705@gmail.com