কাজী ফারহানা ইসলাম: বাংলাদেশে বর্তমান আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অন্যতম। সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই শিশু ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির সংবাদ প্রকাশ্যে আসে। দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের সংখ্যা এবং এদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। দেশে প্রতি চারজন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন এবং প্রতি ছয়জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুধু মেয়ে শিশুরাই নয় ছেলে শিশুরাও এই যৌন হয়রানির শিকার।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, যৌন হয়রানির শিকার শতকরা ৫ ভাগ ছেলেশিশু, মেয়েশিশু শতকরা ৯৫ ভাগ। মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে গত সেপ্টেম্বর মাসেই সারাদেশে ৪৫টি শিশু ও কিশোরীসহ ৭১ জন ধর্ষণের শিকার ঠিক একই সময়ে দেশে শিশু ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪৭টি যার মধ্যে গণধর্ষণ ১৯টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি, প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী ধর্ষণ ৮টি, ধর্ষণের চেষ্টা ২৮টি, যৌন হয়রানি ২২টি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ৪২টি। আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে।
যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে মূলত বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুর বাড়িতে, স্কুলে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বা পরিচিত পরিবেশের মধ্যেই। দেশে শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির কঠিন থাকলেও আইনের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার কারণে দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুরা সাধারণত যৌন হয়রানির শিকার হলে তারা তা প্রকাশ করতে পারে না; যার ফলে অপরাধীরা তাদের অপরাধ চালিয়ে যেতে পারছে।
শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রোধ করতে হলে প্রথমেই এই আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং আইনের ধারা অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে তাছাড়া ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা দেয় এমন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে সব স্তরের মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, শিশুদের প্রতি কোনো প্রকার নির্যাতন মেনে নেয়া হবে না।
আমাদের দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে নানা আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমনÑইভটিজিং বন্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে দণ্ডবিধি ৫০৯ ধারা সংযোজন করা হয়, যা ৯ নভেম্বর ২০১০ থেকে কার্যকর হয়, যাতে বলা হয়েছে সম্মানহানির অভিপ্রায়ে ব্যবহƒত কোনো কথা, কাজ অঙ্গভঙ্গি হচ্ছে শাস্তি যোগ্য অপরাধ ল ম্যাজিস্ট্রেট এ ধারা প্রয়োগ করে অপরাধীকে ঘটনাস্থলে বিচার করে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১০(২) ধারায় বলা হয়েছিল কোনো পুরুষ অবৈধভাবে তার যৌনকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করলে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করলে তার এই কাজ হবে যৌন হয়রানি এবং তজ্জন্য ওই পুরুষকে ৭ বছর কিন্তু অন্যূন ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হবে। কিন্তু এই ধারার অপব্যবহার হতে পারে বলে ২০০৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়। হয়রানিকারীদের উপদ্রব বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর একটি হেল্পলাইন চালু করে অভিযোগ দায়ের করার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভটিজিং প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। আইন কমিশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ২০১০-এর খসড়া প্রণয়ন করে, যাতে গুরুতর ও লঘু শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনে এই শাস্তির কথা উল্লেখ করা থাকলেও তা বাস্তবে প্রয়োগ খুব কম দেখা যায়।
বিচারের দীর্ঘ সময়সীমার জন্য বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে ধর্ষণ মামলা। বিচার পাওয়া নিয়েও শঙ্কা কাটে না ভুক্তভোগীদের। হাইকোর্টের নির্দেশনাও মানা হয় না সঠিকভাবে; যার ফলে বছরের পর বছর আটকে আছে ধর্ষণ মামলার বিচার। যার ফলে সমাজে বেড়েই চলেছে ধর্ষণের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ২০১৫ সালের ২১ মে কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফেরার সময় রাজধানীর কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলন্ত অবস্থায় এক গারো তরুণীকে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় চারদিকে আলোচনার শুরু হলে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন হয় অনেক জায়গায়। ঘটনার কয়েকদিন পর র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে অভিযুক্ত দুজন। কিন্তু ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি মামলাটি। ৩ বছর ধরে মামলাটি ঝুলে আছে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণের অভাবে।
ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ও লেভেলের এক ছাত্রীর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ওই মামলায় স্কুলছাত্রীর কথিত বন্ধু ইফতেখার ফারদিন দিহানকে আসামি করে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। প্রেমে প্রলুব্ধ করে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ, তারপর হত্যা। পুলিশ অভিযুক্ত দিহানকে গ্রেপ্তার করে। ময়নাতদন্তের পর বিকৃত যৌনাচার ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে এবং অভিযুক্ত দিহান ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
আইনের চোখে সবাই সমান। ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির অভিযোগে বিচার হতে হবে শক্ত। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরপরই অভিযুক্তকে হেফাজতে নিয়ে এসে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সকল ধারায় প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারা সমূহকে স্পষ্ট করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার সাপেক্ষে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির রোধের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান জোরদার করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য হ্রাস করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ চাই সকল স্তরেই সচেতনতা। এক্ষেত্রে পরিবারকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি যতœশীল হতে হবে। মূল্যবোধ ও নীতি নৈতিকতার চর্চার অভাবে দেশে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি হচ্ছে। নারী ও পুরুষের মধ্যকার দূষণের ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো সংঘটিত হয়। মানুষের ভেতরে নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ করতে হবে। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। নৈতিকতার সঠিক চর্চা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারে।
সব ধর্মেই ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিকে নিষেধ করা হয়েছে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রোধে ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথ পালন করতে হবে। সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবই পারে অপরাধকে হ্রাস করতে।
অপরাধমূলক কাজ থেকে দূরে রাখতে আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করে, অপরাধীকে শাস্তির আওতায় এনে মানুষকে সচেতন করতে হবে যে আইনের চোখে সবাই সমান, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত। অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে সমাজের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশয় না দিয়ে আইনের সাহায্য নিয়ে আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ প্রতিরোধ করবে।
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রোধ করতে সমাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে, এলাকায় যৌন হয়রানির বা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে করে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হ্রাস পাবে।
সন্তানের আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের কথা গুরুত্বসহকারে শোনা। গুড টাচ-ব্যাড টাচ সম্পর্কে তাদের অবগত করতে হবে। তাদের বয়ঃসন্ধি বা দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। নির্দিষ্ট ব্যক্তি যেমন মা-বাবা ছাড়া অন্য কারও স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সন্তানকে মন খুলে কথা বলতে শেখাতে হবে এবং তাদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সাহসী করতে হবে। শিশু যৌন হয়রানির শিকার হলে ভয় বা সংকোচ না করে তৎক্ষণাৎ আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আইনি ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবহার ও সামাজিক সচেতনতায় শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রোধ করতে পারবে।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়