Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 12:01 pm

শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধীসহ সব পথচারীর জন্য পর্যাপ্ত গণশৌচাগার নিশ্চিত করুন

মো. মিঠুন: বর্তমানে সারা বিশ্বে ৪২০ কোটি মানুষ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন” ছাড়াই জীবন-যাপন করছে। এছাড়া ৬৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ উম্মুক্ত খোলা স্থানে শৌচকর্ম সম্পাদন করছে, যা ডায়রিয়াসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এক দিনে গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এক হাজার অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহারের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করছে। এ বৈশ্বিক সংকট প্রকৃতি এবং প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের জন্য, বিশেষ করে শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য হুমকিস্বরূপ। মাত্র সাত বছর বাকি আছে। এসডিজি গোল ৬-এর স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ টয়লেট এবং নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬- এর অন্যতম লক্ষ্য সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের প্রয়োজনীয়তা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে, এসডিজির লক্ষ্য ৬.২ উš§ুক্ত খোলা স্থানে শৌচকর্ম বন্ধ করা ও পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য প্রতিবেদন ২০২০ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বলেছিলেন, আজ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় আছে। যেখানে ২০৩০ সালের এজেন্ডা, মানবাধিকার উপলব্ধি এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের শহরে নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন ঘর থেকে হাজার হাজার মানুষ বেড় হচ্ছে। কেউ ছুটছে স্কুল কলেজ কিংবা অফিস আদালত বা বাণিজ্যিক কাজের উদ্দেশ্যে। এদের মধ্যে স্কুলগামী শিশু ও নারীরা সব থেকে বেশি যে সমস্যাতে পড়ছে তার মধ্যে সব থেকে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে  প্রয়োজনের সময়ে কাছাকাছি মানসম্মত পাবলিক টয়লেট না থাকা। এমনিতেই ঢাকা শহরে প্রয়োজনের তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা খুবই কম। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১৩৮টি গণশৌচাগারের মধ্যে ঢাকা ডিএসসিসিতে ৯১টি এবং ঢাকা ডিএনসিসিতে ৪৭ গণশৌচাগার রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া যেগুলো আছে সেগুলোর অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর। বেশ কিছু পেশাজীবী মানুষ রয়েছেন, যারা নানা প্রয়োজনের জন্য বাইরে বের হয়ে থাকেন, এর মধ্যে ভাসমান ব্যবসায়ী, রিকশাচালক ও পথচারীর সংখ্যা অনেক বেশি যারা প্রয়োজনের সময়ে হাঁটা পথে ব্যবহার উপযোগী মানসম্মত গণশৌচাগার সেবা পান না। এদের মধ্যে কর্মজীবী নারীদের ভোগান্তির মাত্রা আর বেশি। যদিও একটি শহরের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি আধাকিলোমিটার পরপর গণশৌচাগার থাকা দরকার। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে অনেকটাই ভূমিকা রাখে একটি পরিচ্ছন্ন মানসম্মত টয়লেট ব্যবস্থা। নগরে অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা মানব বর্জ্য নদী, হ্রদ এবং মাটিতে ছড়িয়ে দেয় যা ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের তুলনায় সেখানে শৌচাগার ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, যা আছে সেগুলোও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিশেষ করে কিশোরী মেয়েদের জন্য মানসম্মত ব্যবহার উপযোগী টয়লেট ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এছাড়া দেশের, জনসমাগমস্থলগুলোয় যেমন: লঞ্চ-রেল-বাস টার্মিনাল, হাসপাতাল প্রভৃতি জনসমাগমপূর্ণ জায়গা, সভাস্থল, পাবলিক হল, খেলার মাঠ, বাজার, সিনেমা হল, ঐতিহ্যবাহী স্থানেও পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের অভাবে ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় অধিকাংশ মানুষ রাস্তার আশপাশে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত ব্যবহার-উপযোগী শৌচাগার ব্যবস্থা না থাকায় এবং অপরিচ্ছন্নতার কারণে মেয়েরা বেশিরভাগ সময়ে প্রয়োজন হলেও শৌচাগার ব্যবহার করে না এবং ঘরের বাইরে অবস্থাকালীন টয়লেট ব্যবহার করতে হবে ভেবে মেয়েরা অনেক সময়ে কম পরিমাণে পানি পান করে এবং দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখে। দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকে বা ধরে রাখার ফলে মূত্রথলিতে ব্যথা ও কষ্ট অনুভূত হয় এবং ‘প্রদাহ’ (ইনফেকশন) সৃষ্টি করে। যার ফলে পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মূত্রনালি/থলিতে, কিডনিতে প্রদাহ ও ‘এনাল ফিশার’-এর মতো রোগের প্রকোপ অত্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। পানি কম পান করার কারণে মেয়েরা বড় হয়েও পেটের নানান রোগে ভুগে থাকে। জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব রোধে, নগর এলাকায় পর্যপ্ত গণশৌচাগার নির্মাণ ও তা পরিচালনার জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাস-রেল-লঞ্চ টার্মিনাল, হাসপাতাল খেলার মাঠ, সিনেমা হল, পাবলিক হল, সভাস্থল, গোরস্থান, অস্থায়ী বাজার ইত্যাদি স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্যসম্মত গণশৌচাগারের ব্যবস্থা করা। রেল, নৌ ও অন্যান্য গণপরিবহনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গণসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে গণশৌচাগার ব্যবহার বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি ও প্রতিটি জেলা শহরের জনসংখ্যা অনুপাতে উপযুক্ত স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গণশৌচাগার স্থাপন করা। স্টেডিয়াম, ইজতেমা ময়দানসহ অন্যান্য অস্থায়ী স্থানে যেখানে জনসমাগম বেশি সেখানে ‘ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার’-এর ব্যবস্থা করা, গণশৌচাগার নোংরা, অপরিচ্ছন্ন এবং অন্যান্য সুবিধা না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ইজারা বাতিল বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এসডিজি গোল ৬-এর স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সরকারি পর্যায়ে টয়লেট ব্যবহার ও স্যানিটাইজেশন সম্পর্কে ক্যাম্পেইন বাড়াতে হবে। নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পয়ঃবর্জ্য সরাসরি না ফেলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা, মাঠ, পার্কসহ সব গণপরিসরে সবার ব্যবহার উপযোগী গণশৌচাগার নিশ্চিত করতে হবে। শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সব পথচারীর জন্য উপযোগী গণশৌচাগার নিশ্চিত করতে হবে। সবার জন্য যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ হ্রাসে বিনা খরচে গণশৌচাগার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং নগরে পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত গণশৌচাগার নিশ্চিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসম্মত, পরিষ্কার ও নিরাপদ গণশৌচাগার নিশ্চিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গণশৌচাগার নির্মাণের ব্যপারে নতুন নির্মাণ করা প্রতিটি গণশৌচাগার সব মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে গণশৌচাগারের অভ্যন্তরে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি, গোসলখানা, শিশুদের দুধ খাওয়ানোর কক্ষসহ সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা। জনগোষ্ঠীর ভালো থাকার জন্য স্যানিটেশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

উন্নয়ন কর্মী

mithun.00714@gmacom