শীত আসছে, নিউমোনিয়া বাড়ছে প্রতিরোধে করণীয়

ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী: আসছে শীতকাল। শীতের সময়ে নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। বর্তমানে করোনা মহামারিতে সারা বছরই শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন সমস্যা করোনা রোগীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তবে করোনার জন্য যেন আমরা আসন্ন শীতে শিশুদের নিউমোনিয়ার বিষয়টা ভুলে না যাই। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীতের প্রকোপে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং এখন থেকেই আমাদের উচিত শিশুদের মা-বাবাদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।

নিউমোনিয়া একটি মারাত্মক রোগ। যে কোনো বয়সেই এ রোগ হতে পারে, তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ রোগ বেশি হয়। সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যেই নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেশি। রোগটি বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ার কারণে। প্রতিবছর পৃথিবীতে ১৪ লাখ শিশু মারা যায় শুধু এই নিউমোনিয়ায়, যা সম্মিলিতভাবে হাম, এইডস ও যক্ষ্মায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি। নিউমোনিয়ায় শিশুর ফুসফুস মারাত্মকভাবে সংক্রমণের শিকার হয়। শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহকে ইংরেজিতে বলা হয় রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। এ প্রদাহ যখন জীবাণুঘটিত হয়, তখন এটিকে নিউমোনিয়া বলে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের কারণে নিউমোনিয়া হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে শিশুদের ফুসফুস পুঁজ ও তরলে ভরে যায়, যার কারণে তাদের নিঃশ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হয়।

বাতাসের মাধ্যমেই মূলত নিউমোনিয়া ছড়ায়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির এ রোগ হয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কোনো সুস্থ ব্যক্তি এলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা কোনো জিনিস ব্যবহারের মাধ্যমে তার শরীরে নিউমোনিয়ার জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এ রোগের জীবাণু সুস্থ মানুষের নাক ও মুখে থাকতে পারে, যা শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যেসব শিশুর বয়স দুই বছরের নিচে, যারা অপুষ্টিতে আক্রান্ত, বুকের দুধ পান করেনি (বিশেষ করে শালদুধ), যাদের হাম, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, বিশেষ করে নিউমোনিয়ার টিকা দেয়া হয়নি যাদের, যেসব শিশু বদ্ধ ঘরে ও ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে থাকে, যাদের সামনে ধূমপান করা হয়Ñএসব শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। গ্রামের শিশুদের চেয়ে শহরের শিশুরা বেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর প্রধান কারণ ঘনবসতি ও বায়ুদূষণ। নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জš§ হওয়া, ওজন কম হওয়া অথবা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে পরবর্তী জীবনে সহজেই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ঘটতে পারে।

নিউমোনিয়া প্রথমে সর্দি-কাশির মতো সাধারণ উপসর্গ থাকে, যা পরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি শিশুর জীবন সংকটাপন্ন হয়েও উঠতে পারে। অনেক মা-বাবাই সাধারণ সর্দি-কাশি ভেবে এসব উপসর্গকে শুরুতে গুরুত্ব দেন না। তাই নিউমোনিয়ার উপসর্গ বা লক্ষণগুলো জানা খুব জরুরি। নিউমোনিয়ার লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জ্বর ও শরীরে কাঁপুনি, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট, বুকব্যথা, দ্রুত নিঃশ্বাস (অর্থাৎ দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের শ্বাস নেয়ার হার মিনিটে ৬০ বারের বেশি, দুই মাস থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুদের মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং ১২ মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা মিনিটে ৪০ বারের বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে), পাঁজরের নিচের অংশ ভেতরের দিকে দেবে যাওয়া, ক্লান্তি অনুভব করা, মাথাব্যথা ও শরীরের মাংসপেশি ব্যথা, খাওয়ার প্রতি অনীহা ও বমি-বমি ভাব প্রভৃতি লক্ষণগুলো নিউমোনিয়ার জন্য খ্বুই গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষণগুলো ছাড়াও শিশুর বুকের ভেতর  শাঁ-শাঁ শব্দ হলে, শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়লে এবং খিঁচুনি হলে বুঝতে হবে শিশুটি মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে শিশুকে দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে নিতে হবে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু খাবার ও পানি যেন পরিপূর্ণভাবে পায়, যেন ডিহাইড্রেশনে না ভোগে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যেসব শিশু বুকের দুধ খায়, তাদের বুকের দুধ খাওয়া কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। একই সঙ্গে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল এবং শ্বাসকষ্টের জন্য রোগীদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। তবে ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার মূল চিকিৎসা হলো যথোপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক। সুস্থ হয়ে গেলেও অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স শেষ করতে হবে, তা না হলে রোগী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, সব সর্দি-কাশিই নিউমোনিয়া নয় এবং সাধারণ সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজন নেই।

নিউমোনিয়াসহ শিশুদের সচরাচর হয়ে থাকে এরকম রোগগুলো যেন মাঠপর্যায়ে সহজে চিকিৎসা করা যায় বা সহজে রেফার করা যায়, এজন্য আন্তর্জাতিক পদ্ধতির আলোকে বাংলাদেশ সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আইএমসিআই (ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেস) চালু করেছে। এ পদ্ধতি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারেন এবং সহজেই চিকিৎসা দিতে পারেন। মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষ থেকেই এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়। এটি নিউমোনিয়া শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও শিশুমৃত্যু কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকার গৃহীত সময়োপযোগী পদক্ষেপসমূহ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন শিশুদের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ইপিআই শিডিউলে ৬, ১০ ও ১৪ সপ্তাহ বয়স হলে শিশুদের নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন দেয়া হয়। এসব ভ্যাকসিন মাঠ পর্যায়েও দেয়া হয় এবং তা বিনা মূল্যে। তাই সব বাবা-মায়ের উচিত শিশুকে এসব ভ্যাকসিন দেয়া এবং অন্যদেরও শিশুকে টিকা প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা। আশার কথা হলো ছয় মাসের কম বয়সী যেসব শিশু বুকের দুধ পান করে, তারা নিউমোনিয়ার জীবাণু অনেকটাই প্রতিহত করতে সক্ষম। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে নিয়মিত, যাতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুগঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের আপামর জনগণের কাছে মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা, নারী ও শিশুস্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ে জনগণকে বিশেষভাবে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিকা বা মাতৃদুগ্ধ পানের মাধ্যমে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বল্পমূল্যের অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে সহজেই নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগও চিকিৎসা করা যেতে পারে। তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সুস্থ শিশুকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ এবং ধুলাবালি থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। সব সময় শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখা দরকার। বাসায় মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ বদ্ধ পরিবেশে শিশুসহ সবারই নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের অসুখ হতে পারে। বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ছোটো থেকেই। এ অভ্যাসগুলো করোনা প্রতিরোধেও সহায়ক। এছাড়া খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। শীতকালে শিশুর গোসল, পানি পান করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীকালে খুব সহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই গর্ভকালীন মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতেই হবে, যাতে শিশু অপরিণত বা স্বল্প ওজনের না হয়। আর যদি কোনো শিশু অপরিণত বয়সে জš§ নেয়, তাহলে তাদের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী এক লাখ ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। গবেষকরা আরও দেখিয়েছেন, নিউমোনিয়া মোকাবিলায় প্রচেষ্টা জোরদার করা হলে তা একই সঙ্গে শৈশবকালীন অন্যান্য বড় ধরনের রোগে আরও ৯২ হাজার শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে সক্ষম। শিশুদের পুষ্টির উন্নতি ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান ও টিকাদানের আওতা বাড়ানো, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বাড়ানোÑএ পদক্ষেপগুলো নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনা ও ইউনিসেফের দেখানো পথে আমাদের মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এখন আগের তুলনায় অনেক উন্নত। নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে শিশুমৃত্যু এখন অনেক কমে গেছে। আমরা যদি আরও সচেতন হই, শিশুদের নিউমোনিয়া সম্পর্কে নিজে জানি, অন্যকে জানাই, তাহলে নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য অনেক রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হব। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে আমাদের সবাইকে। তাহলেই সবাই মিলে আগামী দিনের শিশুদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারব আমরা, আর এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা এবং শিশুর জন্য বাসযোগ্য সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার।

পিআইডি নিবন্ধন