শীর্ষ ধনীদের সম্পদ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

আবুল কাসেম হায়দার: বিগত ২০ বছরে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যে হারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে, তা কোনোক্রমেই আশানুরূপ নয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। আমরা অত্যন্ত জাঁকজমক সহকারে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশের জšে§র ৫০তম বছর উদযাপন করেছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী শান্তি, উন্নতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনকৃত ফলাফল পৌঁছে দিতে অনেকটা সক্ষম হলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল দেশের মানুষ লাভ করতে পারেনি।

বিশ্ব অসমতা প্রতিবেদন: ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বিশ্বজুড়ে বেশ বড় ব্যবধান রয়েছে। বাংলাদেশ ও এই থেকে কোনো ব্যতিক্রম নই। দিন দিন আয় বৈষম্য আমাদের সমাজের ব্যবধান বাড়িয়ে চলছে। বিশ্ব অসমতা প্রতিবেদন অনুযায়ী যে চিত্র দেখছি, তা বেশ আলোচনার দাবি রাখে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীদের নিট আয় বৃদ্ধি পায়নি। ২০২০ সালে এই শ্রেণির মানুষের আয়ের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২১ সালে যা অপরিবর্তিত ছিল।

একই সময়ে দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণও অপরিবর্তিত আছে। ২০২০ সালে তাদের হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ মোট জাতীয় সম্পদের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০২১ সালে তা একই আছে।

প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত ২০ বছরে দেশের শীর্ষ ধনীদের সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমেছে। আবার একই সময়ে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত গুণ।

শীর্ষ ধনীদের আয়ও সম্পদ বৃদ্ধি না পেলেও নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে তাদের আয়ও সম্পদের ব্যবধান অনেক। যেখানে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের আয়ের অনুপাত ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণ যেখানে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে তা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে গত ২৭ বছরে দেশের শীর্ষ ধনীদের আয়ও সম্পদের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যেমন শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীদের হাতে সবচেয়ে বেশি আয় ছিল। ১৯৯৫ সালে মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে এই আয় হ্রাসের হার তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। সম্পদের ক্ষেত্রেই একই চিত্র দেখা যায় শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীদের হাতে সবচেয়ে বেশি সম্পদ ঘনীভূত ছিল ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২১ সালে যা নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশে। অর্থাৎ এই শ্রেণির হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণও তেমন একটা কমেনি।

এদিকে ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত গুণ। শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমলেও জিডিপির বহর যে হারে বেড়েছে, তাতে এই শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বাকিদের আয় ব্যবধান অনেকটাই বেড়েছে। তবে এই ২০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। অনেক মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশে দৃষ্টিকটুভাবে বৈষম্য বেড়েছে।

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গত ১০ বছরে দেশের নারীদের শ্রমআয় অনেকটা বেড়েছে। ২০১০ সালে নারীদের শ্রম আয় ছিল মোট আয়ের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৯ সালে যা ১৬ দশমিক ৯ শতাংশে উঠে এসেছে। অর্থাৎ শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, যদিও কভিডের অভিঘাতে অনেক নারী কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

প্রতিবেদনের মুখবন্ধ লিখেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো। মুখবন্ধে তারা বলেন, সঠিক নীতি করা হলে অসমতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, আবার ভুল নীতির কারণে অসমতা লাগামছাড়া হয়ে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে তারা রোনাল্ড রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচারের নব্য উদারনীতিবাদী (বেসরকারি খাতনির্ভর প্রবৃদ্ধি) নীতির সমালোচনা করেছেন। এই নীতির ফলে ভারত ও চীনের প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশের একটি। সে জন্য যথাযথ নীতিপ্রণয়নে গুরুত্ব দেন তারা। এদিকে বৈশ্বিকপরিসরেও দেখা যায়, শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর আয় যেখানে মোট আয়ের ৫২ শতাংশ, সম্পদের ক্ষেত্রে যা ৭৬ শতাংশ। আর বিশ্বের নিচের সারির ২ শতাংশ মানুষের সম্পদে মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তার নতুন বই আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইকুয়ালিটিতে দেখিয়েছেন, গত শতকের শুরুতে ইউরোপে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতেছিল মোট সম্পত্তির প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালে অনুপাতটা দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। তবে গত চার দশকে অসাম্য আবার বেশ কিছুটা বেড়েছে, ইউরোপে তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে খুবই দ্রুত ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পদ, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। সে জন্য তিনি ধনীদেরও পর অনুক্রমিক করারোপের পক্ষপাতী।

আমাদের কী করতে হবে

এক. আমাদের দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর আয় বিগত ২০০০ সালে ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১০ সালে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ; দুই. দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর সম্পদ ২০০০ সালে ৫৯ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২১ সালে তা হয়েছে ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের ১ শতাংশ ধনীর সম্পদ হচ্ছে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ; তিন. আমাদের পরিসংখ্যান সঠিক নয়। এই বিষয় আরও বেশি নজর দিতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রস্তুত করতে হবে। তথ্য সঠিক না হলে পরিকল্পনাও সঠিক হবে না; চার. দেশের ধনীদের হাতে সকল সম্পদ রেখে জাতির সার্বিক কল্যাণ ও উন্নতি করা সম্ভব নয়। সম্পদের ব্যবহার সমতায় আনতে হবে। তাই আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতি বছরের বাজেটে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের রূপ রেখা থাকতে হবে। সরকারকে যত্নশীল হতে হবে। তবেই ধনী দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই হ্রাস পাবে; পাঁচ. ধনীর অর্থ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরিবের পুঁজি কমে ঋণ বৃদ্ধি পায়। প্রতিবেদনে তা দেখা গিয়েছে। তাই ধনীদের কর হারে পরিবর্তন আনতে হবে। বেশি উপার্জন, বেশি কর এই নীতিতে করনীতি আরও বেশি সংশোধন করতে হবে। অনেক উন্নত দেশে তা রয়েছে; ছয়. অর্থ মানুষের জন্য। মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করতে হবে। মানবতার কল্যাণই মানুষের ধর্ম। তাই ইসলামের মৌলিক বিষয় হচ্ছে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য জাকাত প্রবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাই উল্লেখ করেছেন, ধনীদের সম্পদে গরিবদের হক রয়েছে। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তনই ধনী দরিদ্রের পার্থক্য কমানোর একমাত্র উপায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশে দেশে জাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

আমাদের দেশে অর্থনীতির আংশিক একটি বিষয় চালু রয়েছে। তা হচ্ছে সুদবিহীন ব্যাকিং ব্যবস্থা, তাও আবার একটি সার্কুলারের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংকিং আইন এখনও প্রণীত হয়নি। সংসদ কর্তৃক এই আইন প্রণয়ন করা উচিত। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের মধ্যকার বাস্তবায়নে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

আইএফআইএল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ

সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

aqhaider@youthgroupbd.com