রহমত রহমান: হোম টেক্সটাইল খাতে অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। রয়েছে টানা শীর্ষ রপ্তানিকারকের মুকুট। কিন্তু টানা পাঁচ বছর ধরে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। দেশের অন্যতম নোমান গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠান ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কোনো ভ্যাটই পরিশোধ করেনি। ভ্যাট গোয়েন্দার নিরীক্ষায় এই ভ্যাট ফাঁকি উঠে এসেছে। এই ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করেছে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। সম্প্রতি এই দাবিনামা জারি করেছে। তবে চূড়ান্ত দাবিনামা জারির পরও প্রতিষ্ঠান কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা আইনগতভাবে এগোচ্ছে।
এনবিআর সূত্রমতে, গাজীপুরের টঙ্গী পাগার এলাকার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ছয় বছর নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয় মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সে অনুযায়ী নিরীক্ষা দল প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ও বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান ছয় বছরে ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোনো ভ্যাটই পরিশোধ করেনি। ছয় বছরে প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে সুদ ছাড়া ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৪৩ হাজার ১৭১ টাকা। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট আদায়ে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটকে প্রতিবেদন দেয় ভ্যাট গোয়েন্দা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড একটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান। শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হলেও লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে ব্যয় বা কেনাকাটার ক্ষেত্রে উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট) অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি অডিট ফি, ড্রেসিং এক্সপেন্স, রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেইনিং, ড্রায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং চার্জ, প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারিজ, ভেহিকল রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেনিং, এন্টারটেইনমেন্ট এক্সপেন্স, ট্রাভেলিং অ্যান্ড কনভেয়েন্স, লিগ্যাল অ্যান্ড প্রফেশনাল ফি, ডিরেক্টর রেমুনারেশন, মার্কেটিং এক্সপেন্স, বিল্ডিং অ্যান্ড সিভিল কনস্ট্রাকশন, ফার্নিচার, কমপ্লায়েন্স এক্সপেন্স, ডিজাইন এক্সপেন্স, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও অন্যান্য ব্যয়ের ওপর প্রযোজ্য উৎসে কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি।
হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত কেনাকাটা ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য উৎসে ভ্যাট ৩ কোটি ৭০ লাখ ৩২ হাজার ৫৬৩ টাকা। এছাড়া ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪২৭ টাকা, ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ২ কোটি ১৮ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৫ টাকা, ২০১৩
সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ২ কোটি ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯০ টাকা, ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৩১ লাখ ২২ হাজার ১২৮ টাকা, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৪ টাকা। ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৪৩ হাজার ১৭১ টাকা (সুদ ব্যতীত) ভ্যাট পরিশোধ করেনি।
ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রমতে, ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। জবাব দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি লিখিত জবাব দেয়। জবাবে প্রতিষ্ঠানটি বলে, মূসক আইন, ১৯৯১ সালের আইনে মামলা করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১৩ জুন এনবিআরের আদেশে আইনটি ২০১২ সালের মূসক আইনের ক্ষমতাবলে বাতিল করা হয়েছে। মূসক আইন, ১৯৯১ আইন ধরে নিলেও ৫৫ ধারামতে পাঁচ বছরের অধিক সময়ের আগের পাওনা আদায়যোগ্য নয়। মূসক আইন, ২০১২ অনুযায়ী তিন বছরের অধিককাল আগের কোনো কর মেয়াদের জন্য দাবি করা যাবে না। দাবিনামাটি বাতিল করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ২৭ মে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক হাফিজুর রহমান শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি লিখিত জবাবের পুনরাবৃত্তি করে দাবিনামা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
সূত্র আরও জানায়, প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য, ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদন ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ডিজাইন এক্সপেন্স, ট্রাভেলিং অ্যান্ড কনভেয়েন্স, রিপেয়ার অ্যান্ড মেইনটেইনিং প্লান্ট মেশিনারিজ, বিল্ডিং অ্যান্ড সিভিল কনস্ট্রাকশন, ডিরেক্টর রেমুনারেশন, মার্কেটিং এক্সপেন্স, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রযোজ্য নয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠান সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫০ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। সেজন্য ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। তবে ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। পর্যালোচনা অনুযায়ী এই পাঁচ বছরে সুদ ব্যতীত ৭ কোটি ১৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৮ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেনি। মূসক আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাট পরিশোধে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করেছে। পর্যালোচনায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা থেকে সাত কোটি টাকায় নেমে এলেও প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট পরিশোধ করেনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নোমান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম রফিকুল ইসলাম নোমানের ব্যক্তিগত ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। এই বিষয়ে জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক হাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা আইন মোতাবেক এগোচ্ছি। চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে, আপনারা মেনে নিয়ে টাকা জমা দিয়েছেন কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, টাকা দেব কেন? আমরা আইনগতভাবে এগোচ্ছি।
উল্লেখ্য, জাবের অ্যান্ড জোবায়ের বর্তমানে গ্রুপটির ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় হোম টেক্সটাইল পণ্যের বৃহত্তম রপ্তানিকারক। প্রতিষ্ঠানটির ১৮-২০ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে আইকিয়া, এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, টার্গেট, কেমার্ট, ক্যারিফোর প্রভৃতি।