রহমত রহমান: দেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা বিবেচনায় ইলেকট্রনিক লেনদেনে ঝুঁকছে। প্রতিনিয়ত এটিএম (ডেবিট বা ক্রেডিট) কার্ডে গ্রাহককে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছে। দেশে উন্নতমানের কার্ড উৎপাদন হয় না বলে অনেকটাই আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমদানিতে উচ্চ শুল্ককর থাকায় এমনিতেই গ্রাহককে খরচ গুনতে হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে কার্ড আমদানিতে নতুন ট্যারিফ আরোপ করায় এখন গ্রাহককে দ্বিগুণ টাকা গুনতে হবে।
নগদ টাকার ব্যবহার কমাতে সরকার কার্ডনির্ভরতা বাড়ানোর কথা বললেও প্লাস্টিক কার্ডের ওপর আমদানি শুল্ক আর ট্যারিফ বসিয়ে তা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এটিএম কার্ড তৈরির উপকরণের ওপর আরোপ করা শুল্ককর ও নতুন ট্যারিফ প্রত্যাহার করা না হলে এটি উল্টো প্রভাব ফেলবে।
সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক কার্ড বা এটিএম কার্র্ডপ্রতি দুই ডলার, এনএফসি কার্ডপ্রতি তিন ডলার ও ম্যাগস্ট্রাইপ কার্ডপ্রতি দশমিক ৭০ ডলার নতুন ট্যারিফ রেট প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এটিএম কার্ডপ্রতি দুই ডলার, এনএফসি কার্ডপ্রতি তিন ডলার ও ম্যাগস্ট্রাইপ কার্ডপ্রতি আমদানিতে দশমিক ৭০ ডলার ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এ কার্ড আমদানিতে ৭৬ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়।
নতুন ট্যারিফ কার্যকর হলে প্রতিটি এটিএম কার্ডের খরচ পড়বে ২৫০ টাকা (ট্যারিফ দুই ডলার, শুল্ককর ৭৬ শতাংশ, কার্ডের মূল্য, ভ্যাট, পরিবহন খরচ) আর এনএফসি কার্ডে (ট্যারিফ তিন ডলার) ৪০০ টাকা। ব্যাংকগুলো সব খরচের পর বর্তমানে কার্ডপ্রতি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা গ্রাহক থেকে আদায় করে। ব্যাংকগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে ৮৫ থেকে ১২০ টাকায় আমদানি করা কার্ড ক্রয় করে। নতুন ট্যারিফ কার্যকর হলে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত দামে কার্ড কিনবে। আর সেই বাড়তি টাকা খোদ গ্রাহকের ঘাড়ে পড়বে।
ব্যাংকিং ইএমভি চিপ কার্ড আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এলওএস টেকনোলজি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সাল থেকে কার্ড আমদানি করে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে সরবরাহ করে আসছে। কার্ড আমদানিতে নতুন ট্যারিফ ধার্য করায় ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিকদার আশফাক সাঈদের সই করা চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নিরাপত্তাজনিত কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ভিসা, মাস্টারকার্ডসহ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিটি ব্যাংকে চিপসহ ব্যাংক কার্ড প্রদানে নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট বর্তমানে ব্যবহার করা ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ কার্ড বদলে চিপসহ কার্ড প্রদানে নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি এনএফসি কার্ড প্রচলনের ক্ষেত্রে কার্ড মালিকরা যাতে কম সময়ে শুধু কার্ড ছুঁয়ে ট্রানজেকশন করতে পারেন, সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারত, নেপালসহ অন্যান্য দেশে প্রতিবছর এসব কার্ডে খরচ কমে, আর আমাদের দেশে বাড়ে। ট্যারিফ প্রত্যাহার করা না হলে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের উন্নতমানের কার্ড দিতে গিয়ে বাড়তি টাকা নেবে। সেজন্য শুল্ককর ৭৬ শতাংশ থেকে ১০-২০ শতাংশ ও নতুন ট্যারিফ রেট বাতিল করার সুপারিশ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৬০টি ব্যাংক ও ৩১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সব ব্যাংক ও কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা কার্ড ব্যবহার করেন। বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং সেবার আওতায় রয়েছেন প্রায় চার কোটি গ্রাহক। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ গ্রাহক এটিএম কার্ড বা প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার করেন। ২০০১ সাল থেকে এটিএম সেবা চালু হয়। এটিএমে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রের মাধ্যমে ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ বা চিপপ্রযুক্তিযুক্ত প্লাস্টিক কার্ডের দ্বারা লেনদেন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সমস্ত আন্তঃব্যাংক এটিএম সুইচকে সমন্বিত করে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি) চালু করেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ক্যাশ থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ কার্ডে আসতে চাই। গ্রাহকরা কার্ডে অভ্যস্ত হচ্ছেন। কিন্তু ট্যারিফ বৃদ্ধি করায় আমরা হতাশ। কারণ কার্ড আমদানিতে এমনিতেই ৭৬ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়। ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে বাড়তি টাকা গ্রাহককে গুনতে হবে। সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।’
