শুষ্ক মৌসুম শুরুতেই বান্দরবান পাহাড়ে পানি সংকট

প্রতিনিধি, বান্দরবান: সবুজে ঘেরা বনাঞ্চলে পরিপূর্ণ বান্দরবান জেলায় একসময় সময় পানি সংকট ছিল না। কিন্তু বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমান সময়ে অধিকহারে বনাঞ্চল উজাড়, পাথর উত্তোলন করার কারণে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্কমৌসুম হলেই পানির সংকটে পড়তে হচ্ছে। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল) মাসে পানি সংকট আরও তীব্র আকার ধারন করে।

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলা জামছড়ি ইউনিয়নের থাংক্রী পাড়া। এ পাড়ায় মারমা জনগোষ্ঠীর ত্রিশ পরিবারের বসবাস। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শৈনুচিং মারমার মতো পানির সংকটে পড়েছেন পুরো পাড়ার মানুষ। শুধু এ পাড়ায় নয়, এ পাড়ার পাশে বুড়ি পাড়া, সাক্রেডং পাড়া, রোয়াজা পাড়াসহ পাঁচটি পাড়ার ৩ শ’র বেশি পরিবারে প্রায় দেড় হাজার মানুষ পানির সংকটে ভুগছেন। শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় ঝিরি শুকিয়ে গেছে। ঝিরির বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প জমে থাকা পানি ও ঝিরির পাথরের গর্ত থেকে ফোঁটা ফোঁটা চুঁইয়ে পড়া পানি দিয়েই চলে এসব পাড়ার মানুষ।

অতিসম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের গৃহিণী শৈনুচিং মারমা প্রতিদিনের মতো পানির জন্য প্রায় ৫০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেয়ে পানি সংগ্রহ করছেন। দুপুরে জুমের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে রান্নার পানির সংকটে আবার পাহাড়ি ঝিরিতে যেতে হয়। কেউ ভোরে উঠে পানি তুলতে চলে যায় হাতে কলসি নিয়ে।

থাংক্রী পাড়ায় গিয়ে শৈনুচিং মারমা সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, “সকালে পানি নিতে পারিনি, কারণ অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। দুপুরে জুমের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখি রান্নার পানি নেই। তাই এখন আসতে হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন পানির জন্য কষ্ট করতে হচ্ছে।”

স্থানীয় চিং মেউ মারমা ও রেদামা মারমা জানান, ঝিরির ক্ষুদ্র একটি উৎস থেকে বাঁশের ভাঙা খোল বা কলসি বসিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে পানি সংগ্রহ করতে হয়। একটি কলসি ভরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এক কলসি পানির জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। কেউ একবার পানি সংগ্রহ করার পর আবার নতুন করে অপেক্ষার পালা শুরু হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মহিলাদের দীর্ঘ লাইন লেগেই থাকে। এই পানিতেই রান্না, গোসল ও গৃহস্থালির সব কাজ চালাতে হয়।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঝিরির আশেপাশে বনে গাছ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ঝিরিগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। ঝিরির আশেপাশের বনে সেগুন ও রাবার গাছ। এ গাছগুলো পানি ধরে রাখতে পারে না। তাই শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি শুকিয়ে পানির সংকটে ভুগতে হচ্ছে। পানির এই সংকট শুধু দৈনন্দিন কাজের সমস্যা নয়, এটি স্বাস্থ্যঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জামছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যসিং শৈ মার্মা বলেন, শুধু থাংখ্রী পাড়াবাসী পানি সংকটে নেই থাংখ্রীপাড়ার পাশাপাশি আরও চারটি গ্রামও পানির সংকটে ভুগছে। এসব পাড়ায় ৩০০ এর বেশি পরিবারের প্রায় ১৫০০ মানুষ বাস করে। সবগুলো গ্রামে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় মানুষকে অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

পানি সংকটে থাকা গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেসহ সরকারের কাছে আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, “পাহাড়ি অঞ্চলে কঠিন শিলাস্তর ও আয়রনের মাত্রা বেশি থাকায় টিউবওয়েল বসানো কঠিন। তবে কিছু এলাকায় সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।

বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, “ বান্দরবানে অনেকগুলো পাড়া বন (বন সংরক্ষণ) রয়েছে। ওইসব পাহাড়ি পাড়ায় সারাবছর ঝিরি ঝর্ণায় পানি থাকে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে বন সংরক্ষণ করতে পারলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।