Print Date & Time : 10 September 2025 Wednesday 1:30 am

শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোর এখনই সময়

দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে ২০১০ সালের ধস একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। সে বছরের ডিসেম্বরে লাখো বিনিয়োগকারীর ‘ঘরে আগুন লাগে’। কারসাজির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হন অনেকে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। কমিটির রিপোর্টে কেবল সমস্যার দিকটিই তুলে ধরা হয়নি, বরং দেওয়া হয়েছিল ২৫টি সুপারিশÑ যার মধ্যে ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে পুনর্গঠন, শেয়ার কারসাজি ঠেকাতে আইন-কানুনে সংস্কার এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার নানা দিকনির্দেশনা।

কথা হচ্ছে, এর পরবর্তী সময়েও কি বাজারে স্বচ্ছতা ফিরেছে? আংশিক কিছু সংস্কার হয়েছে ঠিকই, যেমন বিএসইসির পুনর্গঠন, প্লেসমেন্ট শেয়ার নীতির পরিবর্তন ও স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন। এমনকি প্রযুক্তিনির্ভর সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। কিন্তু অনিয়ম কি বন্ধ হয়েছে? উত্তর হলো- না। এখনও পুঁজিবাজারে কারসাজি চলছে। এখনও কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তারপর একসময় মূল্যহ্রাস পেয়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। পুরোনো সেই কৌশল, কৃত্রিমভাবে দর বাড়িয়ে মুনাফা তুলে নেয়া, আজও বহাল রয়েছে। আর এর পেছনে যে কিছু প্রভাবশালী চক্র জড়িত, সেটা বাজার সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, কিন্তু বিচার হচ্ছে না। কেবল দু’একজনকে দেখানো শাস্তি দিয়ে দায় সারা হচ্ছে।

তদন্ত কমিটির সুপারিশের অনেকটাই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু রাঘব বোয়াল তৎকালীন মিডিয়ার চাপের মুখে সরে গেলেও আজও তারা আইনের আওতার বাইরে। এই দায়হীনতার সংস্কৃতিই সুযোগ দিয়েছে নতুন করে কারসাজির। এখন সময় এসেছে কঠোর অবস্থান নেয়ার। কেবল প্রযুক্তি দিয়ে নয়, শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা দিয়েই বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব। অতীতে যারা কারসাজি করেছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) স্বাধীনতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করাও সময়ের দাবি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি রাজনৈতিক প্রভাব, দলীয়করণ কিংবা স্বজনপ্রীতির কবলে পড়ে, তাহলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। বিএসইসির কমিশনারদের নিয়োগে স্বচ্ছতা, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের পর্যবেক্ষণ রাখার মতো ব্যবস্থাও প্রবর্তন করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বপ্ন বাঁচাতে হলে পুঁজিবাজারে এখনই সত্যিকারের শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি।

পুঁজিবাজার শুধু কিছু শেয়ারের দাম ওঠানামার খেলা নয়, এটি মানুষের জীবনের সঞ্চয়, একজন পেনশনপ্রাপ্ত বৃদ্ধের শেষ সম্বল, একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এই বাজারে অনিয়ম মানে কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি একটি জাতির আস্থার সংকট। পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে অতীতের দায়মুক্তি বন্ধ করতে হবে। বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে, কঠোর নজরদারি ও স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে বাজারকে সত্যিকারের উন্নয়নের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করাই এখন সময়ের দাবি।