শেয়ার ধারণের নির্দেশনা উপেক্ষা, শাস্তির মুখে ৪৪ কোম্পানি

মো. রাহাতুল ইসলাম : পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৩৯ কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা শেয়ার ধারণের নির্দেশনা মানছেন না। বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পৃথক ক্যাটেগরি গঠনের ঘোষণা এবং বারবার সময় বেঁধে দেয়া হলেও সেই নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর কঠোর অবস্থানে বিএসইসি। কোম্পানিগুলোকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। চিঠিতে কোম্পানিগুলোকে আবারও নিয়ম মেন চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। নির্দেশ না মানলে আইনি মেনে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারে গতি ফেরানোর অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা দেয় বিএসইসি। ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ মেনে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের নির্দেশ দেয় বিএসইসি। নির্দেশনা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের (স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়া) সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে কমপক্ষে দুই শতাংশ শেয়ার না থাকলে কোনো উদ্যোক্তা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু বিএসইসির নির্দেশনা সবসময়ই উপেক্ষিত। তাই বারবার এসব বিষয়ে কঠোর হতে হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম শেয়ার বিজকে বলেন, কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কোম্পানির সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এখনও অনেক কোম্পানি সেই শর্ত পরিপালন করেনি। যেসব কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হয়েছে, সেই কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আইন না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে কোম্পানিগুলোয় স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্তও নিয়েছে বিএসইসি।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৪টি কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের নির্দেশনা মানছে না। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের কোম্পানির মধ্যে ডেল্টা স্পিনার্সের ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, তাল্লু স্পিনিংয়ের ২৯ দশমিক ৬১ শতাংশ, মিথুন নিটিং অ্যান্ড ডায়িংয়ের ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনসের ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, ফ্যামিলিটেক্সের ৪ দশমিক ১ শতাংশ, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, জীবন বিমা খাতের সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ওষুধ ও রসায়ন খাতের অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালসের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ, সালভো কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ, এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেকের ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ফু-ওয়াং ফুডসের ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, বঙ্গজের ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, ফাইন ফুডসের ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, প্রকৌশল খাতের আজিজ পাইপসের ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ, আফতাব অটোমোবাইলসের ২৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, বিডি থাই অ্যালুমিনিয়ামের ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশ, অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্সের ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ, সুহƒদ ইন্ডাস্ট্রিজের ১২ দশমিক ১ শতাংশ, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের ২৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের ২৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, অলিম্পিক অ্যাকসেসরিজের ২৫ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং সিরামিকস খাতের স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি খাতের ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্কের ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ শেয়ার উদ্যেক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। এর বাইরে ব্যাংকিং খাতের সাতটি, লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স খাতের ছয় কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ৩০ শতাংশের নিচে রয়েছে। কোম্পানিগুলোকে দফায় দফায় নির্দেশ দেয়ার পরও কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা তা উপেক্ষা করছেন। এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করা কোম্পানির সংখ্যা এখন ৪৪টি। গত ১৭ এপ্রিল এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে শেয়ার বিজ। এরপর বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। গত মঙ্গলবারের কমিশন সভায় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে বিএসইসি। এ সিদ্ধান্তের পর শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো।

এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে আইনে সম্পূরক সংযোজনী এনে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত পূরণ না হলে শেয়ার বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বা উপহার হিসেবে শেয়ার হস্তান্তর এবং বোনাস শেয়ার দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ারধারণের শর্ত পূরণ না করে পদে থাকায় ৯টি কোম্পানির ১৭ পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণের শর্ত পূরণে ব্যর্থ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছিল। আর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত পূরণে ব্যর্থ তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ে নতুন ক্যাটেগরি করার কথা জানায় বিএসইসি। কোম্পানিগুলোর জন্য দুই স্টক এক্সচেঞ্জে পৃথক ক্যাটেগরি চালু করতে বলে বিএসইসি। সেই নির্দেশনাও আলোর মুখ দেখেনি। সে কারণেই বিএসইসি পুনর্গঠনের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে এবং নতুন করে এ ইস্যুতে কঠোর হচ্ছে বিএসইসি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু নির্দেশ দেয়া বা সিদ্ধান্ত নেয়াই মূল বিষয় নয়, কোম্পানিগুলো সেটা মানছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবেই কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর কোম্পানিগুলো নিয়ম মানলে তার ইতিবাচক প্রভাব কোম্পানির আয়-মুনাফায় পড়বে। এতে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারী উভয়ই উপকারী হবে।