শোক হোক আমাদের শক্তি

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা:বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের খোকা থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন সৎ, সাহসী, নির্ভীক, মিতব্যয়ী, রাজনীতি ও অধিকার সচেতন একজন মানবদরদি নেতা। তিনি প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবনে তার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে একটি শোষণমুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে প্রতিটি মানুষকে উন্নত জীবন নিশ্চিত করা।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি অবিনাশী নাম। ছাত্র অবস্থায় নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে ত্যাগ করে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের কল্যাণে কাজ করেছেন। অধিকার সচেতন হওয়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে জড়িয়ে পড়েছেন রাজনীতিতে।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গায় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জীবন বাজি রেখে উপদ্রুত এলাকায় আর্তমানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ক্সএর নির্বাচন এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির মহানায়ক, রাজনীতির কবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিসংবাদিত নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। ৫৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এক চতুর্থাংশ সময়ই কারাগারে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। দিন ও বছর হিসাবে ৪ হাজার ৬৮২ দিন। দাম্পত্য জীবনে পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তানদের সাথে থাকতে পারেনি জাতির পিতা। কারাগারে ছিল জাতির পিতার দ্বিতীয় আবাসস্থান। যশ, খ্যাতি, সম্মান, ক্ষমতা, সম্পদের মোহ কিংবা লোভ কোনোটাই তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি।

১৯৫৭ সালে দেশকে ভালোবেসে মন্ত্রিত্ব থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন বিশ্বের সকল নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির অগ্রনায়ক।

ইতিহাসের এক অন্যতম দিন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। এদিন বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন ‘… যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সেই হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ সেদিন বঙ্গবন্ধু বুঝিয়েছিলেন মেজরিটি লোক যেটা বলে তার নাম গণতন্ত্র নয়। যেটি সত্য, যেটি ন্যায্য কথা তার নাম গণতন্ত্র। এই ভাষণে তিনি গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ  এবং সব মানুষের মনের কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং সকল জনগোষ্ঠীর সহ-অবস্থানকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অসাম্য দূর করার আন্দোলনে সম্পৃক্ততা হওয়ায় ছাত্রত্ব হারিয়েছেন কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপস বা মাথা নত করেননি। পাকিস্তানি সামরিক শাসকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে দৃঢ়চিত্তে বজ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনÑ‘এবারের সংগ্রাম  মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় শাসকগোষ্ঠী তাকে ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’। ২৪ বছরের নিরালা সাধনায় সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও তিনি অহংকারী, বিলাসিতা কিংবা স্বেচ্ছাচারক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ও পারিবারিকভাবে কিছুই করেননি। এদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আড়ম্বরহীন, বাহুল্যবর্জিত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোসের্র ময়দানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান’। জাতির পিতার রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তি হলো অসাম্প্রদায়িক চিন্তা। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ একই সূত্রে গাথা।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস, হাট-বাজার, ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতি সাধন, অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্যের কোঠায়, খাদ্য মজুদ শূন্য, ভারতীয় মিত্র বাহিনীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনসহ চরম প্রতিকূলতার মুখে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছর  সরকার পরিচালনার সময় পান তিনি। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন ও ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত পরিবারের পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান ও সামাজিক মর্যাদা, তাদের সুচিকিৎসা, পাকিস্তানে আটকে পড়া সেনাবাহিনীর ১ লাখ ২২ হাজার বাঙালি দেশে আনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, রেল চলাচলের ব্যবস্থা, ১০ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর, আনসার পুনর্গঠন করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, অভিন্ন গণমুখীশিক্ষা, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষক কমিশন গঠন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ে সাধনের জন্য ও উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন, ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, কয়েক লাখ প্রাইমারি শিক্ষককে সরকারি মর্যাদা দান, ১১ হাজার নতুন প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা, সমুদ্র আইন পাস, ভারতের সঙ্গে ছিট মহল বিনিময় চুক্তি, ১২৬ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর, বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, পরিকল্পনা ও প্ল্যানিং কমিশন গঠন, সরকারি কর্মকাণ্ডে ও জাতীয় জীবনে বাংলার প্রচলন ইত্যাদি।

এমন সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যখন অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত হয় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। পৃথিবীতে রাজনৈতিক অনেক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। যেমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের নেতা মার্টিন লুথার কিং, ব্রিটিশবিরোধী ও অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিৎজার প্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিসহ অনেক হত্যাকাণ্ডকে হার মানিয়েছে এই রাত্রি।

শুধু জাতির জনককে নয়, পুরো তার পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সেদিন। সেই ভয়াল রাতে। একদিকে একদল চলে গেল শেখ মনির বাড়ি, একদল গেল আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি, অন্য দল চলে গেল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আর একটা দল রেডিওতে। স্বাধীনতার সেøাগান ‘জয় বাংলা’কে নির্বাসিত করা হলো।

১৫ আগস্টের মতো ট্র্যাজেডি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টা ঘটে নাই। কোনো রাষ্ট্রনায়কের পরিবারকে এভাবে হত্যা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও ঘাতকরা তার স্বপ্নকে হত্যা করতে পারেনি। অলৌকিকভাবে সেদিন বেঁচে যাওয়া তারই যোগ্য উত্তরসূরি আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার জন্য দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করছেন। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা শুধু উন্নত বাংলাদেশি নয়। সেটা হবে সাম্যের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, মানুষে মানুষে ভালোবাসার বাংলাদেশ। বাঙালির রাজনীতির ইতিহাসে মহানায়ক একজনই ছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির ইতিহাসে তিনি চিরকাল অক্ষয়, অমর হয়ে রবেন।  জাতির পিতার এই শাহাদাতবার্ষিকীতে সকল শহিদের অতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন। শোকের এই মাসে আমরা শপথ নিই শোক হোক আমাদের শক্তি।

সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়