শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থারও উন্নয়ন হোক

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশের পোশাকশিল্প খাতের নানা সংস্কারে বেশ কিছু কারখানার মান বৃদ্ধি পেলেও সার্বিকভাবে শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি এমন তথ্য উঠে এসেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে। এটা শুধু সংশ্লিষ্ট খাতের ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতির চিত্রই প্রকাশ করে না। আমরা মনে করি, পোশাকশিল্প খাতে সংস্কারের যেসব প্রক্রিয়া চলমান; সেগুলো পরিপালন করতে গিয়ে শুধু কারখানা ও কাজের পরিবেশের উন্নতি করলেই চলবে না শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা ও জীবনমানের উন্নতি যাতে হয়, সে পদক্ষেপও নিতে হবে। এক্ষেত্রে খোদ মালিকদের দেখাতে হবে ইতিবাচক মনোভাব। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার প্রত্যাশিত উন্নতি না হলে বিভিন্ন সূচকে খাতটির অনগ্রসরতার যে উদাহরণ ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, সে ধারা অব্যাহত থাকবে। মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা থাকলে বাধাগ্রস্ত হতে পারে এ খাতের প্রবৃদ্ধিও।

সিপিডির এ-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বর্তমান গড় মজুরি প্রায় সাত হাজার টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে কারও আয় গড় মজুরির খানিকটা বেশি। সন্দেহ নেই, সিংহভাগ শ্রমিকই তাদের পরিবারে প্রধান উপার্জনকারী। বর্তমান বাজারে যে মজুরি তারা পান, একটি পরিবারের মোটামুটি মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য তা যথেষ্ট কিনা জোরালো প্রশ্ন রয়েছে সে ব্যাপারে। নিকট অতীতে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে পোশাকশিল্প শ্রমিকরা যেসব সমাবেশ করেছেন, সেখানেও এসব ইস্যু উত্থাপন করেছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য মনে করেন, তৈরি পোশাক খাতের ভ্যালু চেইনে যে অন্যায্য পরিস্থিতি বিদ্যমান, এক্ষেত্রে সংস্কার এনে শ্রমিকদের উৎসাহব্যঞ্জক মজুরি জোগানো সম্ভব। এ অবস্থায় উচিত হবে তাদের বক্তব্য আমলে নেওয়া। শুধু শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার দিকে লক্ষ রেখে নয়, বিভিন্ন সূচকে তৈরি পোশাকশিল্প খাতের নেতিবাচক ধারা রোধ করতেও এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, উৎসাহজনক মজুরি ও মুনাফার ভাগ দিলে ক্ষেত্রবিশেষে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ে। মালিক পক্ষ শ্রমিকদের এসব সুবিধা জোগালে কারখানাকে নিজের বলে ভাবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তাদের মধ্যে। এ থেকে প্রতিষ্ঠান পায় এক ধরনের সুফল। কোনো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের মধ্যে এমন মনোভাব ব্যাপকভাবে আনা সম্ভব হলে তার উন্নয়নও হয় টেকসই। অধ্যাপক রেহমান সোবহান যথার্থই বলেছেন, ‘এজন্য উনিশ শতকের ধ্যান-ধারণা ছেড়ে একুশ শতকের মডেলে কারখানা পরিচালনা করতে হবে।’ আমরা আশা করব, তার এ বক্তব্যকে গুরুত্বসহ নেবেন পোশাকশিল্প মালিকরা। শ্রমিকদের জীবন বাস্তবতা উপলব্ধি করে তারা যদি উপযুক্ত আর্থিক প্রণোদনা জোগানোর পদক্ষেপ নেন, তাহলে তৈরি পোশাকশিল্পে বিদ্যমান আরও কিছু সমস্যার সমাধান হবে বলেও মনে হয়।

লক্ষণীয়, নিজেদের স্বার্থ হাসিলে মালিক ও ক্রেতা সংস্থাগুলো যেমন ঐক্যবদ্ধ, শ্রমিকদের ঐক্য পরিস্থিতি ততটাই নড়বড়ে। এ কারণেও দাবি আদায়ে তারা পিছিয়ে পড়ছেন বলে মনে করেন অনেকে। শ্রমিক নেতারা একতাবদ্ধ হতে পারছেন না কেন সেটাও বড় প্রশ্ন। তাদের বোঝা উচিত, এ ধারা থেকে বেরোতে না পারলে শুধু মজুরি বৃদ্ধি নয়, অন্যান্য সহজ দাবি আদায়ও তাদের পক্ষে কঠিন হবে। এজন্য একতাবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে তাদের মনোযোগ দিতে হবে সবার আগে। এক্ষেত্রে মালিক পক্ষকেই তারা নিতে পারেন উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে। নীতিনির্ধারকদেরও এটা মনে রাখা ভালো, স্টেকহোল্ডারদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পক্ষকে বঞ্চিত বা ক্ষুব্ধ রেখে তৈরি পোশাকশিল্পে ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন কঠিন। বাস্তব কারণে শ্রমিকদের কিছু বিষয়ে চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের সচেতনতা। প্রত্যেক কারখানার মালিক এটি উপলব্ধি করে শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে যেন পদক্ষেপ নেন, সংগত কারণেই সেটি নিশ্চিত করতে হবে নীতিনির্ধারকদের।