মো. জিল্লুর রহমান:পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়। পৃথিবীর শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কাছে এ দিনটি একদিকে যেমন খুবই তাৎপর্যময় ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত, তেমনি অনেক বেশি আবেগ ও প্রেরণার উৎস। ১৮৮৬ সালে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় শ্রমজীবী মানুষের বিজয়ের ধারা। সেই বিজয়ের ধারায় উদ্ভাসিত বর্তমান বিশ্বের সব প্রান্তের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ। কারণ এ দিনটির মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ তাদের কাজের প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। পহেলা মে এক দিনের আন্দোলনের ফসল নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে কিছুটা প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে এই দিনে। তাই ঐতিহাসিক মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে স্মরণীয় দিনটি সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, আইএলও সনদেও এটা অনুমোদিত। শ্রমিক শ্রেণির লাগাতার সংগ্রামের অন্যতম ট্রিগার পয়েন্ট ১ মে দিনটিকেই শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ও বিজয়ের প্রতীকী দিবস হিসেবে ধার্য করা হয়। এ দিনটি ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর লাখ লাখ শ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করে। এ ধর্মঘট ৩ ও ৪ মে ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। কিন্তু আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার জন্য পুলিশ গুলি চালায়। এতে ১০ শ্রমিক প্রাণ হারায় এবং একই সঙ্গে বহু শ্রমিক আহত ও অসংখ্য শ্রমিককে গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মধ্যে ছয়জনকে পরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এবং এক শ্রমিক নেতা জেলখানায় বন্দি অবস্থায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। শ্রমিক আন্দোলনের এই গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের সব দেশেই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রমিক আন্দোলনের একজন নেতা বলেছিলেন, ‘এমন সময় আসবে যখন কবরের অভ্যন্তরে শায়িত আমাদের নিশ্চুপ অবস্থা জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বাঙ¥য় হবে এবং তা শ্রমিক শ্রেণির বিজয় লাভের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত লড়াইয়ে প্রেরণা জোগাবে। এটি শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ তার সেদিনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে, ব্যর্থ হয়নি তাদের সেই আত্মদান। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্মরণীয় অধ্যায়। তাদেরই আত্মদানে প্রতিষ্ঠিত (মহান মে দিবস) পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে। আজ তাই মে দিবস হাজার হাজার শ্রমিকের পায়ে চলা মিছিলে কথা ও আপসহীন সংগ্রামের কথা বলে। মে দিবস দুনিয়ার শ্রমিকের এক হওয়ার ব্রত এবং আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর ভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবসের অর্থ শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন, জাগরণের গান, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা। মে দিবস শোষণমুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরের ত্রাণ ও দিন বদলের শপথ।
কিন্তু উদ্বেগের বিষয় শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের কিছু অধিকার অর্জন করলেও সব দিক থেকে শ্রমিকরা তাদের অধিকার পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। মে দিবস ঘটা করে পালন হলেও শ্রমিকরা আজও অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার। আজও তারা তাদের কাক্সিক্ষত মজুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। কর্মক্ষেত্রে আট ঘণ্টা শ্রমের নিয়ম হয়তোবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু থামেনি শ্রমিক নিপীড়ন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে প্রায়ই শ্রমিক আন্দোলনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আফ্রিকায় এখন শ্রমিকরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে আমরা সহজেই এটা অনুধাবন করতে পারি। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের নিমিত্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অধিকাংশ গার্মেন্ট শিল্পে নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। চা শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও তাদের কাক্সিক্ষত মজুরি পাচ্ছে না। গার্মেন্ট শ্রমিকরা প্রায়ই তাদের দাবি আদায়ে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছে। মালিক পক্ষ হরহামেশাই শ্রমিকদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতানেত্রীদের গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে। কাজেই এটি দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, আজও দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সু-সম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারগুলো স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে এবং এর মধ্যে বাংলাদেশ আটটি কোর কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাচ্ছে, শ্রমিকদের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হয়েছে, আজ এই সময়ে তা কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিকসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে, কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য যেন আর খোলে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শ্রমিকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, নানা ক্ষেত্রে নানাভাবে উপেক্ষিত। অনেক কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীন এবং ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্ট খাতে শ্রমিকদের জন্য সর্বনি¤œ মজুরি নির্ধারিত হলেও সব ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হচ্ছে না। অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রের অবস্থা আরও নাজুক। বহু প্রতীক্ষার পর দেশে একটি শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে, যেখানে কৃষি শ্রমিকরা স্বীকৃতি পেয়েছেন। মহিলা ও পুরুষ গৃহকর্মীদেরও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার নীতিমালা হচ্ছে। এগুলো আশার কথা। তবে এর বাইরেও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকরা অধিকার বঞ্চিত রয়ে গেছেন। শিল্পক্ষেত্রে সুস্থ অবস্থা তৈরির জন্য এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনমানের নিশ্চয়তা দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশাÑশিল্প মালিক, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন যে, সুস্থ শিল্প বিকাশের স্বার্থে শ্রমিকের মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। অন্যতম প্রধান শ্রম খাত গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় নিয়ামক বিদেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রবাসে ও স্বদেশে ওই শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
তবে বাংলাদেশে বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দুরবস্থার মূল কারণ হচ্ছে, তারা মালিক বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হয়ে একে অন্যের বিরোধিতা করছে। শ্রমিকের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজ দলের স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে গার্মেন্ট শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু এখানেও প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৬৩ হাজার শ্রমিক ইউনিয়ন করার অনুমতি পেয়েছে, তাও আবার নানা শর্তের বেড়াজালে বন্দি। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপের যে তৎপরতা দেখা গিয়েছিল, আজ তারাই সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন শ্রমিক দিবসে কথা বলতে গেলে শুধু দেশের ভেতরে যারা কাজ করছে তাদের কথা নয়, দেশের বাইরে প্রবাসী শ্রমিকদের কথাও বলতে হবে। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়ে এই শ্রমিকদের বিদেশে পাঠায় এবং তাদের পাঠানো ডলার-পাউন্ড-রিয়ালে দেশের কোষাগার ভরে যায়, তখন যদি কেউ তাদের অধিকারের কথা না বলে কিংবা তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয়, এর চেয়ে বড় অন্যায় আর প্রহসন কিছুই হতে পারে না।
আসলে শ্রমিকদের বঞ্চনার জন্য কোনো কোনো মালিক যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী একশ্রেণির শ্রমিক নেতাও। আবার দেশের গার্মেন্ট শিল্পের বিরুদ্ধে রয়েছে বিদেশি ষড়যন্ত্রও। এসব নানা কারণে দেশের গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক ও মালিকের স্বার্থ বিঘিœত হচ্ছে। শিল্পে শ্রমিক-মালিকের ন্যায্য স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ব্যাপারে নানা তত্ত্বের দায়ও কম নয়। যে শ্রমিকের শ্রম-মেধায় মানবসভ্যতার বিকাশ, উত্থান ও মালিকদের বিত্তবৈভব, সেই শ্রমিককে ঝুঁকির মাঝে ফেলে ছাঁটাই করে এবং অর্ধাহারে-অনাহারে রেখে মে দিবসের মর্যাদা রক্ষা করা যায় না। আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাÑএসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটার বাস্তবায়নই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা এবং এখানেই মে দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।
ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক