শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান: অর্থনীতির কাঠামো ব্যবস্থাপনায় বিশেষ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ যেমন ঋণখেলাপি, মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি বাজেট প্রভৃতি বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে অর্থনীতিতে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় তাই হচ্ছে অর্থনীতিক বিপর্যয়। অর্থনীতি বিপর্যয় অর্থনীতিতে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু অর্থনীতিতে এই বিপর্যয় প্রাথমিক অবস্থায় সামাল দিতে না পারলে ভঙ্গুর অর্থনীতিক কাঠামো ব্যবস্থা তৈরি হয়ে দেশের অবস্থানের গতিপথ পাল্টে যায়। যে অবস্থার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময় অতিবাহিত করছে শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা অন্যতম একটি দেশ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সংবলিত সমুদ্রসৈকত, ভূদৃশ্য, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য শ্রীলঙ্কা সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় বিরাজ করছে গভীর সংকট। যে সংকটের আচ্ছন্নে দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছে দেশটি। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথম এতবড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে দেশটিকে। ঋণের ফাঁদে জর্জরিত দেশটি ইতোমধ্যে নিজেদের ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি সৃষ্টির কয়েকটি কারণ পরিলক্ষিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা শ্রীলঙ্কার এই বর্তমান সংকটকালীন পরিস্থিতি হুট করে তৈরি হয়নি। অপরিকল্পিত নীতি বাস্তবায়ন, পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণ, মূল্যস্ফীতি, ঋণের জটে আটকা ইত্যাদি ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কাকে আজকের এই দুরবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। শ্রীলঙ্কা তাদের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নানা দেশের থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো শোধ করতে গিয়ে সে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়েছে।
লঙ্কানদের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ হচ্ছে চীন। গত এক দশকে চীনের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়ছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণ দিয়ে শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে। বেশিরভাগ অবকাঠামো প্রকল্প সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। যেমন হাম্বানটোটায় স্থাপিত বিমানবন্দরটি অব্যবহারকৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণ শোধ করতে না পেরে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছে চীনের কাছে। চীন ছাড়াও জাপান, ভারত, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছে ঋণ রয়েছে শ্রীলঙ্কার। বাংলাদেশের কাছ থেকেও শ্রীলঙ্কা ২৫ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কা হচ্ছে পর্যটননির্ভর দেশ। পর্যটন থেকে দেশটির সিংহভাগ আয় অর্জিত হয়। কিন্তু করোনাকালীন বা গত দুই বছরে পর্যটন খাত থেকে দেশটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আর্থিক সাফল্য অর্জন হয়নি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলংকার নাগরিকদের পাঠানো ডলার। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে সেটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তাছাড়া দেশটি তাদের দক্ষ মানবসম্পদকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়াও এই সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
এর ফলে ধুঁকতে হচ্ছে দেশটিকে। যার প্রভাব পড়েছে দেশটির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্যসহ প্রতিটি খাতে। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী। জ্বালানি তেলের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি কাগজের অভাবে স্কুল পর্যায়ে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকছে না ১০ ঘণ্টা। দেশের সাধারণ মানুষের অনিশ্চয়তা ও আহাজারিতে কলম্বোতে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনের সামনে প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে বারংবার। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশটির রাজধানীতে কারফিউও ঘোষণা করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশে শ্রীলঙ্কা অর্থনীতিতে অগ্রসরমান একটি দেশ ছিল। তাদের দেশের শিক্ষার হার শতকরা ৯৫ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় চার হাজার ডলারের বেশি। কিন্তু এতকিছুর পরও শ্রীলঙ্কার এই আর্থিক বিপর্যয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাকি দেশগুলোর জন্য সতর্কবার্তা। শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের যেকোনো দেশই শিকার হতে পারে। তবে বাস্তবিকই বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিক কাঠামো ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি সূচক শক্ত অবস্থানে রয়েছে। প্রতিটি খাত থেকে লক্ষ্য অর্জনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে পোশাক, ওষুুধ, রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য খাতগুলোতে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের পরিমাণ এবং রপ্তানি আয় দিন দিন বাড়ছে। শুধু গত মার্চ মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ১৮৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। দেশীয় মুদ্রায় যা (প্রতি এক ডলার সমান ৮৬ টাকা হিসাবে) ১৫ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও দেশের অর্থনীতিক অবস্থান বেশ ইতিবাচক ছিল। মোটা দাগে বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে।
শ্রীলঙ্কার এই সংকট থেকে ইতিবাচক দিক গ্রহণ করে বাংলাদেশকে এখনই সময়োপযোগী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনকে মূল প্রাধান্য দিতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের প্রতিটি খাতে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। দেশের স্থানীয় সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়নে তৃণমূলে বিশেষ নজর দিতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো অবকাঠামো উন্নয়নকে মূল প্রাধান্য দেয়া যাবে না। সঠিক পরিকল্পনা, নীতিমালা ও উদ্ভাবনী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ভারসাম্য অর্থনীতিক অবস্থান তৈরি করতে হবে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হবে। দেশের মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেটে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এতে বিশ্বের বুকে দেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় ও গাঢ় হবে। যার ফলে দেশে ও বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশের সাফল্যযাত্রা শতভাগ অব্যাহত থাকবে।
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়