সংকট কাটাতে ভাড়া কমল ১০ থেকে ৫৫ শতাংশ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং লকডাউনের কারণে প্রায় ৬০০ লাইটার জাহাজ মাসের পর মাস অলস বসেছিল। আর শিল্পমালিকদের লাইটার জাহাজ নিজেদের পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহন করে। এতে সংকটে পড়ে সাধারণ জাহাজ মালিকদের ব্যবসা। আর সংকট উত্তরণের অংশ হিসেবে গন্তব্য বিবেচনায় ১০ থেকে ৫৫ শতাংশ ভাড়া কমিয়েছে, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এতে আমদানিকারকদের পরিবহন ব্যয় কমবে।

ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সিল সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারবিহীন জাহাজে আমদানিকৃত পণ্যের ৮০ শতাংশই নদীপথে পরিবহন হয়। আর লাইটার জাহাজের শতভাগ পণ্য পরিবহন করে। সাধারণত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, সন্দ্বীপ, আরিচা, মোংলা, বাবুবাজার, আশুগঞ্জ, বাঘাবাড়ি, চাঁদপুর, নিতাইগঞ্জ, ঝালকাটি, পটুয়াখালী, মিরপুর, ছাতক, মোল্লারহাট, কয়রা, মাওয়া, নবীগগঞ্জ, ইটনা, লেবুখালী, বরগুনা, বাকেরগঞ্জসহ মোট ৩৪টি গন্তব্যে ভোগ্যপণ্য, ক্লিংকার, ইস্পাতের কাঁচামাল, পাথর প্রভৃতি পৌঁছে দেয়া হয়। এর মধ্যে বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় টনপ্রতি ভাড়া ছিল ৫৪৮ টাকা; যা বর্তমানে ৪১৫ টাকা। অর্থাৎ আগের ভাড়া থেকে ২৪ শতাংশের বেশি কমেছে।

অন্যদিকে কুতুবদিয়া থেকে বাঁশখালীর বাহারছড়া গন্তব্যে ভাড়া ছিল ৮৯৮ টাকা; যা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৪০০ টাকা। অর্থাৎ ৫৫ শতাংশের বেশি ভাড়া কমানো হয়েছে। এভাবে সব গন্তব্যের ভাড়া ১০ থেকে ৫৫ শতাংশ কমানো হয়। মূলত করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং লকডাউনের কারণে প্রায় ৬০০ লাইটার জাহাজ মাসের পর মাস অলস বসেছিল। আর শিল্পমালিকদের লাইটার জাহাজ নিজেদের পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্যও পরিবহন করে। এতে সংকটে পড়ে জাহাজ মালিকদের ব্যবসা। আর সংকট কাটাতে ভাড়া কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।

বেশ কয়েকজন লাইটার জাহাজ মালিক বলেন, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসির নিয়ন্ত্রণাধীন দেড় হাজার সিরিয়াল অনুয়ায়ী পণ্য পরিবহন করে। কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন প্রায় ২৫০টি লাইটার ভেসেল এবং তাদের পণ্য আনা-নেয়ায় চার শতাধিক ভাড়া করা জাহাজ সিরিয়াল অনুসরণ করত না। ফলে আমাদের জাহাজগুলো অলস বসে থাকত। করোনা এবং লকডাউনে মাসের পর মাস প্রায় ৬০০ জাহাজ বসে ছিল। এতে আমাদের বিপুল লোকসান গুনতে হয়। এমনকি লোকসানের দায়ে জাহাজ ব্যবসা ছেড়ে দেন অনেক ব্যবসায়ী। এছাড়া এ খাতের ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের প্রণোদনা পাননি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জাহাজ মালিকরা ভাড়া কমিয়েছেন। এতে আমদানিকারকরা লাভবান হবে। এতে পরিবহন ব্যয় কমবে।

এ বিষয়ে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ খান বলেন, কারখানা মালিক বা আমদানিকারকের জাহাজে আমদানি করা কাঁচামালের ৫০ শতাংশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নিয়ন্ত্রণাধীন জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করতে হবে। আর সব লাইটার জাহাজ সিরিয়ালভুক্ত হয়ে চলাচল করবে। তবে আমদানিকারকের জাহাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিরিয়াল পাবে। কিন্তু অন্য আমদানিকারকের পণ্য ভাড়ায় পরিবহন করতে পারবে না। এ কারণে বিভিন্ন গন্তব্যে ভাড়া কমানো হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে লাইটার জাহাজ পরিচালনায় শৃঙ্খলা আসবে।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, এক দশক আগে নদীপথে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনে লাইটার জাহাজের সংকট ছিল। এতে আমদানি করা কাঁচামাল বন্দর থেকে নদীপথে কারখানা বা গন্তব্যে নিতে অনেক সময় ও অর্থ নষ্ট হতো। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য লাইটার জাহাজে বিনিয়োগ বাড়িয়ে ছিল বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা। এতে দ্রুত সময়ে এবং কম খরচে কারখানায় নেয়ার সুফল পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। আর ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল থেকে জাহাজ নিলে টনপ্রতি যত ভাড়া দিতে হয়, তার প্রায় অর্ধেক খরচে নিজস্ব জাহাজে পণ্য পরিবহন করা যায়। এ কারণে তারা ভাড়া কমিয়েছেন; যা ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, নৌপথে পণ্য পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সিরিয়ালভুক্ত হওয়া ঠিক আছে। আমরা সিরিয়ালভুক্ত হতে পারি। কিন্তু আমাদের যদি শতভাগ পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা থাকে, তবে আমরা শতভাগ পণ্য পরিবহন করব। কেন আমরা ৫০ শতাংশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নিয়ন্ত্রণাধীন জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করব? এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক। আর আমাদের সঙ্গে মিটিং তো সিদ্ধান্ত হয়েছে শিল্প মালিকরা নিজেদের পণ্য নিজেদের লাইটার জাহাজের পরিবহন করবে।

উল্লেখ্য, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতে বছরে প্রায় আট কোটি টন পণ্য লাইটার ভেসেলের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং করা হয়, যা পুরোটাই লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। আর লাইটার জাহাজ মালিকদের ৮০ জন লোকাল জাহাজের এজেন্ট এবং ৩২ জন পণ্যের আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের পুরো ব্যাপারটি পরিচালনা করে। সংস্থাটির প্রতিদিন আমদানিকারকের চাহিদা অনুসারে পণ্য পরিবহনে জাহাজ বরাদ্দ দেয়।