সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সরকার ও নির্বাচন

আলী ওসমান শেফায়েত: ভোট একটি দেশের জনগণের অন্যতম গণতান্ত্রিক অধিকার। এর মাধ্যমে জনগণ কোনো ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচিত করে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত নির্বাচনি ব্যবস্থায় গরিষ্ঠতামূলক শাসন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার উপস্থিতি দেখা যায়। এছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একক বিজয়ী ব্যবস্থা, বহু বিজয়ী ব্যবস্থা, পছন্দানুক্রম ব্যবস্থা, দলীয়-তালিকা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অতিরিক্ত সদস্য ব্যবস্থারও প্রচলন দেখা যায়। স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে গণতন্ত্রের একটা স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন রাজনৈতিক-গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত। যে ধরনের নির্বাচনি ব্যবস্থাই অনুসরণ করা হোক না কেন তাতে জনগণের অবাধ-ভোটাধিকার প্রয়োগ ও ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা নির্বাচনের প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর থেকে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও বাংলাসহ সব প্রদেশ বা রাজ্য পর্যায়ে আইনসভার সাধারণ নির্বাচন দৃশ্যমানভাবে সূচিত হয়েছিল। নির্বাচন উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের যে পদ্ধতি কয়েক শতাব্দী ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে, ইরেজিতে যাকে বলা হয় ঋরৎংঃ চধংঃ ঞযব চড়ংঃ (ঋচঞচ). এর সঠিক বাংলা নেই। ঘোড়দৗড়ের পদ্ধতি থেকে কথনটি এসেছে। এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো একটি নির্বাচনি কেন্দ্রে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকলে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত ঘোষিত হবেন। আধুনিক গণতন্ত্রে এটিই ছিল দীর্ঘ অনুসৃত পদ্ধতি।
বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে নির্বাচনের এই পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত এমন একটি পদ্ধতির নাম হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। ইংরেজিতে যাকে চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ (চজ) ঝুংঃবস বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।

মনে করুন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে ১৫০০ থেকে ১৭০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ৩০০টি নির্বাচনি কেন্দ্র থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক নির্বাচনি কেন্দ্র। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবেন সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবেন। যেমন- ‘ক’ দল মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫০দ্ধ৩ = ১৫০টি, ‘খ’ দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৪০দ্ধ৩ = ১২০টি, ‘গ’ দল ৫ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫দ্ধ৩ = ১৫টি এবং ‘ঘ’ দল ৫ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৫দ্ধ৩ = ১৫টি। এভাবে সংসদের ৩০০টি আসন পূরণ হবে। এটিই হচ্ছে পিআর পদ্ধতির সাধারণ ফর্মুলা। কোনো একটি দল যদি দশমিক ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে থাকে, তা হলে তার আসন হবে মাত্র একটি। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করে। অধুনা বিশ্বের প্রায় ১০০টির অধিক দেশ কোনো না কোনো ধরনের চজ পদ্ধতি অনুসরণ করছে।

বলা আবশ্যক, আদি ঋচঞচ পদ্ধতিতে নির্বাচনি এলাকায় এবং কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠানে যেকোনো পন্থায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা বা অপচেষ্টায় যে ধরনের বিভিন্ন অপকর্ম, সহিংসতা ইত্যাদির চর্চা হতো চজ পদ্ধতি তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকবে। চজ পদ্ধতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, এখানে নির্বাচনি অনিয়ম, অপকর্ম, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে। নির্বাচনি কর্মকর্তারা, পুলিশ বা প্রশাসনকে অবৈধ অর্থ দিয়ে পক্ষাশ্রিত করা সম্ভব হয় না। একই প্রার্থীর একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকে না। কোনো প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। নারীদের সংরক্ষিত আসনে ভিন্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক হবে না। নমিনেশন দাখিল কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে এবং অবশিষ্ট ৭৮ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে। চজ পদ্ধতিতে এটি কখনোই সম্ভব হবে না।

বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৬০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে কেবল ৪০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনেই ৩০০টি আসন পূরণ সম্ভব। চজ পদ্ধতিতে ১০০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনে সরকার গঠিত হোক বা না হোক, ১০০ শতাংশ ভোটারের সমর্থনেই সংসদ পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ১০০ শতাংশ ভোটার, সংখ্যা যদি ৮ কোটিও হয়, তাদের সবাই সংসদের অভ্যন্তরে প্রতিনিধিত্বপ্রাপ্ত হবেন।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যয় অনেক হ্রাস পাবে। এই পদ্ধতিতে নারীদের জন্য অমর্যাদাকর লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক ৫০ থেকে ৬০টি আসন ভিন্নভাবে সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হবে না। যদি মনে করা হয়, ৩০০টি আসনের মধ্যেই নারীদের জন্য অনূর্ধ্ব ৬০টি আসন ব্যবস্থিত থাকবে, তা হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আইন দ্বারা বাধ্য করা যাবে যে নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের পক্ষে দাখিল করা তালিকায় প্রতি ১০ জনের প্রথম দুজন বা শেষ দুজন নারী হবেন।

তা হলে সে দলের পক্ষে নারী প্রার্থী হবেন ৩০০ জনের মধ্যে ৬০ জন। ১৯৭২ সালের ৭ দশমিক ৫০ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। এমন বিবেচনায় সংসদের আসন সংখ্যা ৩৫০ থেকে ৪০০-তে বর্ধিত করা যেতে পারে।
পিআর পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের তালিকা ওপেন লিস্ট বা ক্লোজড লিস্ট আকারে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে পারে। ওপেন লিস্টে ভোটার সাধারণ এবং দলের সদস্যরা আগেই জেনে যাবেন দলের প্রার্থী কারা। এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। জনগণের জন্য ভালো, তারা প্রার্থীদের গুণাগুণ আগাম বিশ্লেষণ করে দলের সক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারবেন।
মন্দ দিক হলো, দলের অভ্যন্তরে এতে অনাকাক্সিক্ষত কোন্দল-রেষারেষি হতে পারে। ক্লোজড লিস্টের সুবিধা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগে দলের প্রার্থী কারা ছিলেন তা গোপন থাকবে। ফলে দলের ভেতর সম্ভাব্য কোন্দল বা রেষারেষি পরিহার করা সম্ভব হবে। নির্বাচন সহজ, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হবে।

পিআর পদ্ধতিতে অনেক সময় কোনো দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ (১৫০টির অধিক) আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এটি খুব কঠিন জটিল বিষয় নয়। প্রয়োজনে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হবে।
কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব না হলে তাৎক্ষণিক সংসদ ভেঙে না দিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনপ্রাপ্ত দলকে অবিলম্বে সরকার গঠনের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। এতে শূন্যতার তাৎক্ষণিক সংকট পরিহার করা যাবে। সংখ্যালঘু দল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারলে দুই থেকে তিন বছর পর একই পদ্ধতিতে আবার সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার গঠন এবং আইন পাস বা বিভিন্ন অনিবার্য উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু দলকে খবমধষ ঋরপঃরড়হ-এর মাধ্যমে ধারণাভিত্তিকভাবে (উববসবফ) ১৫১টি আসন প্রাপ্ত মর্মে সাময়িকভাবে গণ্য করা যেতে পারে। সাময়িক এমন ব্যবস্থা সংবিধান বা যথোপযুক্ত আইনি বিধান দ্বারা করা যেতে পারে।

স্বাধীন ভারতে বিগত ৭৫ বছরে কোনো সামরিক শাসন বা গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা ছিল নিরবচ্ছিন্ন। স্বাধীন পাকিস্তান অতঃপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা মূলত কখনোই হয়নি। ১৯৭৪-এ বাকশাল, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব হয়েছে। সংবিধান অকার্যকর হয়েছে। ১৯৮১ সালে আবারও সামরিক অভ্যুত্থানে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলো। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। সংবিধান অকার্যকর হয়েছিল। ১৯৯৬-এর গণ-অভ্যুত্থানেও অসাংবিধানিক পদ্ধতিতেই সরকার পতন হয়েছিল। পুনর্বার নির্বাচন হয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসাংবিধানিক অবস্থানকে পরবর্তী সময় অনুমোদন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়েছিল। দুটি নির্বাচন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অধিক স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৭ সালে আবারও গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। কথিত সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। একটি নির্বাচন ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করতে পারেনি।

২০০৯ সালে মইনউদ্দীন ও ফখরুদ্দিনের পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সূত্রে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী রহিতকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পূর্ববর্তী দুটি অধিকতর স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিবিম্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করে। একদলীয় শাসনের প্রতিচ্ছবি আওয়ামী লীগ সরকার গণদাবিকে উপেক্ষা করে পরপর তিনটি (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) একদলীয় নির্বাচন করে। কিন্তু ২০২৪-এ ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আসলে দুর্ভেদ্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া জনপ্রত্যাশিত অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন কঠিন। ইতিহাস তাই বলে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হবে। স্বৈরাচারের পতন হবে। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে সে আবার ওঠে আসবে। জনৈক ব্রিটিশ মনীষী বলেছিলেন, ৎেবধঃবংঃ ষবংংড়হ ড়ভ যরংঃড়ৎু রং ঃযধঃ ঢ়বড়ঢ়ষব ফড় হড়ঃ ষবধৎহ ভৎড়স যরংঃড়ৎু.
অনেকেই বলছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে আমূল ঢেলে সাজাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। প্রথমে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা বন্দোবস্তে মৌলিক পরিবর্তন ও সংস্কার প্রয়োজন হবে। তাহলে নির্বাচনব্যবস্থা সেই আদলে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তিত হবে। চজ ঝুংঃবস কার্যত নির্বাচন পদ্ধতি নয়।

এটি পার্লামেন্ট বা সংসদে আসন বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি উন্নততর পদ্ধতি। পিআর পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে নির্বাচন পদ্ধতি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিয়ে অনুসরণ করবে। বলা প্রয়োজন, জনঘন বাংলাদেশের জনগণের সমজাতীয়তা বা সমরূপতা (যড়সড়মবহবরঃ) দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে চজ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।
বর্তমান এফপিটিপি পদ্ধতির নির্বাচনে ভোটেকন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া, ব্যালট বাক্সে ব্যালট জোর কর প্রবিষ্ট করা, কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে। নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদ উপার্জনের মনস্তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এখন সর্বজনবিদিত। প্রথমত সামান্য ভোটের ব্যবধানেই যে কেউ বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। এতে ভোটের সামান্যতম পার্থক্য সত্ত্বেও আসনের ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য হতে পারে। আরেকটা সমস্যা হলো, যেহেতু আসনভিত্তিক, সেহেতু দ্বন্দ্ব, হানাহানি, মারামারি, ভোট জালিয়াতির প্রবণতা বেশি হয়। সহিংসতার সম্ভাবনা থাকে ব্যাপক। এই পদ্ধতিতে যারাই একবার নির্বাচিত হন, তাদের অনেকটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায়। তাদের আর সরানো প্রায়ই আর সম্ভবপর হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা ধনী, অর্থকড়ির মালিক, এই পদ্ধতি তাদের জন্য সুবিধাজনক। তারা মনোনয়ন কিনে এবং টাকা-পয়সা খরচ করে নির্বাচন জিততে পারে। এখানে জনপ্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রে বিবেচিত হলেও যোগ্যতা গুরুত্ব পায় না।’

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তার কলামে লিখেছেন, ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে অর্থের ছড়াছড়ি কমানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ও কমে আসবে। তাছাড়া প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। নারীর সংরক্ষিত আসনে ভিন্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক হবে না।’ প্রয়াত আকবর আলি খানও তার বইয়ে লিখে গেছেন, ‘বর্তমান যে পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে, তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান পদ্ধতি বাংলাদশের জন্য সঠিক নয়। ফলে বাংলাদেশে সংঘর্ষের রাজনীতি ক্রমে তীব্র হচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে। তাই আনুপাতিক পদ্ধতির ভোটে জাল-জালিয়াতি, সংঘাত-সহিংসতা কমবে।’
গত ২০ নভেম্বর নির্বাচন ভবনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একবারেই ভোটগ্রহণ করতে হবে। বারবার ভোটগ্রহণ করে এত কাগজ নষ্ট, এত অর্থ ব্যয়ের দরকার নেই।’ সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালুর প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘সংসদীয় পদ্ধতি থাকবে। আমেরিকার মতো ওই দ্বিক্ষক বিশিষ্ট সংসদ আনার দরকার নেই। নির্বাচনকে সরলীকরণ করতে হবে।’

সাবেক সিইসি আরও বলেন, ‘মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কেননা মনোনয়নপত্র বাণিজ্যই নির্বাচনি বাণিজ্য এনেছে। ২০ কোটি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনব, ১০ কোটি টাকা মাঠে ছড়াব। পাঁচ বছর থাকলে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা লাভ করব, সোজা হিসাব। এমপিদের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে এজন্য। কাজেই আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হবে।’
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য এখনও হয়নি। কেউ কেউ এর পক্ষে বলছে, আবার কেউ বিপক্ষে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর অদিকাংশই সংখ্যানুপাতিকের পক্ষে সুপারিশ করে। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি সংখ্যানুপাতিকের পক্ষে। বাম দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনের পাশাপাশি গণঅধিকার পরিষদও এর পক্ষে। তবে বিএনপি সংখ্যানুপাতিকের বিষয়ে তাদের অবস্থান না জানালেও দলটির নেতারা প্রচলিত পদ্ধতি রাখার পক্ষে বলছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সক্রিয়তা না থাকায় এ-বিষয়ে তাদের অবস্থান জানা যাচ্ছে না। বর্তমান পদ্ধতি থেকে সরে এসে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রচলন করতে গেলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে বলে মনে করেন নির্বাচন সংস্কার কমিটির সদস্য ও ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, ‘এটা করতে গেলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।’ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের জন্য সবদলের ঐকমত্যের প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।

আমাদের দেশে মূলত দলীয় সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়ে থাকে। এ কারণেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। মূলত সরকার সরাসরি না করলেও সরকারদলীয় প্রার্থীরা স্থানীয়ভাবে প্রবল শক্তিধর হয়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটি বাস্তবতা। এটি দীর্ঘ অপচর্চার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অপশক্তির অর্জিত এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত নষ্ট ঐতিহ্য। নির্বাচনে এমন অপচর্চা শুধু বাংলাদেশেই নয়। দেশে দেশে হচ্ছে। সম্প্র্রতি কেনিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে নির্বাচন-উত্তর অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিক্ষোভ, সহিংসতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত কার্যকর সংস্কার ও পরিবর্তন অনিবার্যভাবে প্রয়োজন।

বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক তথা মোড় পরিবর্তনকারী অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পাশাপাশি তা বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, বিরাজমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন তথা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করা।